পাইলট-কন্ট্রোল রুমের শেষ কথোপকথন, কি ভুল হয়েছিল তাদের মাঝে?

পাইলট-কন্ট্রোল রুমের শেষ কথোপকথন, কি ভুল হয়েছিল তাদের মাঝে?

অবতরণের বিষয়ে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের ভুল সংকেতের কারণে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হতে পারে বলে সন্দেহ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষের। তবে ত্রিভুবন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলেছে, নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী উড়োজাহাজটি অবতরণ করেনি।

 

এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের সঙ্গে পাইলটদের কথোপকথনের একটি অডিও গতকাল সোমবার ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ে। সেই কথোপকথনে সংকেত নিয়ে ভুল-বোঝাবুঝির বিষয়টি স্পষ্ট বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ পাইলটরা।

 

নেপালের সংবাদমাধ্যমগুলোকে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, উড়োজাহাজটি খুব নিচু দিয়ে উড়ছিল এবং হঠাৎ তীক্ষ্ণ বাঁক নেয়। এরপর উড়োজাহাজটি অদৃশ্য হয়ে যায় এবং ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়।

 

কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে একটি। রানওয়ের দক্ষিণ দিকের সংকেত জিরো টু (০২)। আর উত্তর দিকের রানওয়ের সংকেত টু জিরো (২০)। বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের (এটিসি) সঙ্গে পাইলটের যে কথোপকথন শোনা যায়, উড়োজাহাজটিকে প্রথমে রানওয়ের জিরো টু অর্থাৎ দক্ষিণ দিক দিয়ে নামতে বলে টাওয়ার। এর কিছুক্ষণ পরেই সেটিকে উত্তর দিক থেকে নামতে বলা হয়। এরপর আবার বিমানটিকে সেদিকে যেতে মানা করা হয়। শেষ চার মিনিটের কথোপকথন শেষে টাওয়ার থেকে চিৎকার করে উড়োজাহাজটিকে ঘুরতে বলা হচ্ছিল।

 

বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের সঙ্গে বেতার যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইউএস-বাংলার সংকেত ছিল বিএস-২১১। টাওয়ার থেকে ডাকা হচ্ছিল বাংলা স্টার টু ওয়ানওয়ান নামে।

 

কথোপকথনের প্রথমে টাওয়ার থেকে বলা হয় ‘রানওয়ে জিরো টু ইজ ক্লিয়ারড’। অর্থাৎ দক্ষিণ রানওয়েতে বিমানটি নামতে পারে। এর মধ্যেই জিরো টুতে আরেকটি উড়োজাহাজকে নামতে সংকেত দেয় টাওয়ার। এরপরের কথোপকথনগুলো ছিল এ রকম

 

টাওয়ার: আপনারা রানওয়ে টু জিরোর (উত্তর) দিকে যাচ্ছেন।

 

পাইলট: হ্যাঁ, ম্যাডাম।

 

এর মধ্যেই দক্ষিণের রানওয়েতে অন্য উড়োজাহাজটি নামার চূড়ান্ত সংকেত দেয় টাওয়ার। এরই মধ্যে ইউএস-বাংলার বিমানটিকে উত্তরের দিকে যেতে নিষেধ করে।

 

পরের কথোপকথনটা ছিল এ রকম:

 

টাওয়ার: বাংলাস্টার টু ওয়ানওয়ান আমি আবারও বলছি। রানওয়ে টু জিরোর (উত্তর) দিকে না যেতে। বর্তমান অবস্থা বজায় রাখুন।

 

পাইলট: আমরা ডান দিকে বৃত্তাকার পথে ঘুরে আসছি। ডান দিকে ঘুরে ডান পথে রানওয়ের জিরো টুর (দক্ষিণে) দিকে যাচ্ছি।

 

টাওয়ার: ঠিক আছে, খুব ভালো। কিন্তু ল্যান্ড করবেন না। রানওয়ে জিরো টুতে ট্রাফিক চূড়ান্ত অবস্থায় আছে।

 

টাওয়ার: বর্তমান অবস্থা বজায় রাখতে পারেন।

 

কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটি রানওয়ের মধ্যে কোনটিতে পাইলট নামতে চান সে বিষয়ে জানতে চায় টাওয়ার।

 

টাওয়ার: বাংলাস্টার টু ওয়ানওয়ান। কোন রানওয়েতে নামতে চান। জিরো টু অথবা টু জিরো।

 

পাইলট: আমরা টু জিরোতে (উত্তর রানওয়ে) নামতে চাই। (কথোপকথনের ১ মিনিট ২২ সেকেন্ড)

 

টাওয়ার: ঠিক আছে। রানওয়ে টু জিরো ল্যান্ডিংয়ের জন্য ক্লিয়ার। বাতাসের গতি ২৭০ ডিগ্রি ৬ নট।

 

পাইলট: জানলাম (কপিড)। ল্যান্ডিংয়ের জন্য ক্লিয়ার।

 

টাওয়ার: বাংলাস্টার আপনারা কি রানওয়ে দেখতে পাচ্ছেন, নিশ্চিত করুন।

 

পাইলট: নেগেটিভ স্যার

 

টাওয়ার: বাংলাস্টার টু ওয়ানওয়ান ডানে ঘুরুন...এখনো রানওয়ে দেখতে পাচ্ছেন না?

 

পাইলট: হ্যাঁ, পাচ্ছি...ল্যান্ডিংয়ের জন্য অনুমতি চাচ্ছি। (রিকোয়েস্টিং ক্লিয়ার টু ল্যান্ড স্যার।)

 

টাওয়ার: হ্যাঁ, অনুমতি দেওয়া হলো। (২ মিনিট ২২ সেকেন্ড)

 

এতক্ষণ রানওয়ের উত্তর অংশে নামার কথোপকথন চলছিল। উত্তর অংশে নামার অনুমতি পাওয়ার ঠিক এক মিনিটের মাথাতেই পাইলট আবার দক্ষিণ (জিরো টু) রানওয়েতে অবতরণ করতে যাচ্ছেন বলে জানালেন। টাওয়ারও অনুমোদন দিল। এ সময়ই আবার পাইলট টাওয়ারকে জিজ্ঞেসও করলেন তাঁদের অবতরণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে কি না? জিরো টুতে অনুমোদন দেওয়ার ঠিক ৫০ সেকেন্ড পরে টাওয়ার চিৎকার করে ডান দিকে ঘুরতে বলে। এর কিছুক্ষণ পরেই রানওয়ে বন্ধের ঘোষণা আসে।

 

শেষ কথোপকথনটা ছিল এ রকম:

 

পাইলট: বাংলাস্টার টু ওয়ান ওয়ান রানওয়ে জিরো টুতে (দক্ষিণ) ল্যান্ডিং করতে যাচ্ছে। (ল্যান্ডিং অন জিরো টু। বাংলাস্টার টুওয়ান ওয়ান।)

 

টাওয়ার: রানওয়ে জিরো টু (দক্ষিণ) ল্যান্ডিংয়ের জন্য ঠিক আছে। (রজার, রানওয়ে জিরো টু ক্লিয়ার টু ল্যান্ড বাংলাস্টার টু ওয়ান ওয়ান)

 

এরপরে টাওয়ার অন্য বিষয়ে কিছু কথা বলে। কিছু কথা হয় টাওয়ারের ভেতরে নেপালি ভাষায়। এ সময় টাওয়ার থেকে ইউএস-বাংলাকে বলা হয়, আপনারা কি বর্তমান অবস্থা বজায় রাখতে পারবেন?

 

পাইলট:...স্যার আমরা কি নামতে পারি (...স্যার আর উই ক্লিয়ার টু ল্যান্ড?)

 

টাওয়ার: বাংলাস্টার টু ওয়ান ওয়ান আমি আবারও বলছি ঘুরুন। (বাংলাস্টার টুওয়ান ওয়ান আইসে অ্যাগেইন, টার্ন...)

 

এর মধ্যে কিছু গোলোযোগের মতো শোনা যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে টাওয়ার আবার সক্রিয় হয়ে রানওয়ে বন্ধের ঘোষণা দেয়।

 

ইউটিউবে এই কথোপথন শোনার পর ঢাকায় একজন অভিজ্ঞ পাইলট প্রথম আলোকে বলেন, ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজটি প্রথমে জিরো টুর দিকে নামছিল। তখন টাওয়ার থেকে টু জিরোর দিকে যেতে বলা হয়। এত নিচে নেমে আসার পর উড়োজাহাজকে দিক পরিবর্তন করতে বলা ঠিক হয়নি।

 

দুই পক্ষের বক্তব্য

 

রাজধানীর বারিধারায় গতকাল সন্ধ্যায় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইমরান আসিফ সাংবাদিকদের বলেন, নেপালের এটিসির (এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল) সঙ্গে পাইলটদের কথোপকথনের একটি রেকর্ড ইউটিউবে এসেছে। তাতে এটিসির পক্ষ থেকে পাইলটদের ভুল বার্তা দেওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা সন্দেহ করছি, আমাদের পাইলটদের ভুল বার্তা দেওয়ার কারণে এই দুর্ঘটনাটি সম্ভবত ঘটেছে।’

 

ইমরান আসিফ বলেন, ওই ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন ছিলেন একজন অভিজ্ঞ পাইলট। তিনি পাইলটদের প্রশিক্ষকও ছিলেন।

 

ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মহাব্যবস্থাপক রাজকুমার ছেত্রীর বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিধ্বস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত উড়োজাহাজটির পাইলট নিয়ন্ত্রণকক্ষকে জানিয়েছিলেন, কোনো সমস্যা নেই। তবে পাইলট উড়োজাহাজটিকে বিমানবন্দরের উত্তর-পূর্ব দিক থেকে অবতরণ করাতে চাচ্ছিলেন।

 

রাজকুমার ছেত্রী বলেন, বিমানবন্দরে নামার অনুমতি পাওয়ার পর উড়োজাহাজটির পাইলট বলেন, তিনি উত্তর দিকে নামতে চান। তখন নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, কোনো সমস্যা আছে কি না। এর জবাবে পাইলট জানান, কোনো সমস্যা নেই। অবতরণের আগে দুবার আকাশে চক্কর দেয় উড়োজাহাজটি। তিনি বলেন, এরপর অবতরণে অসংগতি দেখে নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে পাইলটকে জানিয়ে দেওয়া হয়, উড়োজাহাজটি ঠিকভাবে অবতরণ করছে না। কিন্তু এ কথার কোনো জবাব পাইলটের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

 

রাজকুমার ছেত্রী বলেন, উড়োজাহাজটি নিয়ন্ত্রণকক্ষের নির্দেশনা ঠিকভাবে অনুসরণ করেনি। একপর্যায়ে সেটি বিমানবন্দরের দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়।

 

বিমানবন্দরটি দুর্ঘটনাপ্রবণ

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একের পর এক দুর্ঘটনার কারণে নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির নিরাপত্তা নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয়। ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৭০টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৬৫০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সর্বশেষ দুর্ঘটনার শিকার হলো ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজটি।