আজব ট্রেনে সওয়ারি: মুস্তাইন সুজাত

আজব ট্রেনে সওয়ারি: মুস্তাইন সুজাত

দেখতে দেখতে সাত নম্বর প্লাটফর্ম থেকে হুট করে ট্রেনটা ছেড়ে দেয়। ট্রেনে ওঠার পরপরই সিগারেটের তীব্র নেশায় পেয়ে বসে রইসুকে। রুইয়াকে সিটে বসিয়ে রেখে একটুর জন্য নিচে নেমেছিলো। এরই মাঝে কেইবা জানতো ট্রেনটা ছেড়ে দেবে? ছুটন্ত ট্রেনে উঠার সময় পা ফসকে পড়ে যেতে যেতেও কোন রকমে বেঁচে যাওয়া রইসু যতবার না শোকর আদায় করে পরোয়ারদিগারের কাছে তার চেয়ে হাজারবার বেশি

শোকর আদায় করে তার পত্নী রুইয়া। রইসু আর রুইয়া চট্টগ্রামমুখী সুবর্ণা এক্সপ্রেসে কক্সবাজার যাচ্ছে। বিয়ের পর এই প্রথম ঢাকার বাইরে ঘুরতে যাওয়া একসাথে। একটি মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে সদ্য প্রমোশন পাওয়া ম্যানেজার রইসু। অফিসের ব্যস্ততায় কোন ফুসরত মেলে না তার। সপ্তাহান্তে যে দু’দিন ছুটি মেলে নিত্য দরকারেই কেটে যায়। নিকুঞ্জ-২’এ তিন রুমের একটা ফ্ল্যাট নিয়েছে। বেশ গোছানো, খোলামেলা চারদিক। রুইয়াকে ঢাকায় নিয়ে আসে প্রায় বছর হতে চলল। রুইয়ার আবার সমুদ্র দেখার সখ অনেক দিনের। বিয়ের পর থেকেই বায়না কক্সবাজার ঘুরতে যাবে।

একসময় রইসুর মনে হয়, এ শুধু বায়না নয় যেন অষ্টপ্রহর কানের কাছে কাঁসার থালা পেটানো। অথচ প্রথম যেদিন পাত্রী দেখতে গিয়েছিলো রইসু, ঘোমটার আড়াল থেকে কি মিষ্টি কণ্ঠই না ভেসে এসেছিলো। মুগ্ধ হয়েছিলো রইসু। পাশ থেকে এক বন্ধু বলেছিলো, কনেকে কেমন যেন একটু স্বাস্থ্যবতী টাইপের মনে হয় রে রইসু? আর একটু চিন্তা করে দেখবি নাকি? রইসু উল্টা বন্ধুকে হালকা ধমকেছে। হোক না একটু মোটা, মেদ ভুঁড়িওয়ালা তাতে কি? এক ফাঁকে ভবিষ্যৎ পতি-পত্নীকে নিরালায় কথা বলার সুযোগ দিয়ে যখন মুরুব্বীরা অন্য ঘরে চলে যায়, প্রাথমিক পরিচয় পর্বের পরই বুঝে যায় রইসু এই মেয়ে আর যাই হোক অবুঝ হবে না স্বামীর সংসারে। আলো করে রাখবে নিজগুণে। বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই রইসুর ধারনা পাল্টে যায়। এখন রুইয়া যখন কথা বলে যেন বাজ পড়ে কোথাও। সুরেলা কণ্ঠ ক্রমে ক্রমে হয়ে যায় বেসুরা কর্কশ-রসকসহীন। আর এ কয় দিনেই দেহখানি দেড়গুণে উন্নীত করে।

সিটে বসার পরপরই আরেক পশলা কাঁসার ঝনঝনানি কানের কাছে বেজে উঠে। রইসু নিশ্চুপ থাকে। অবশ্য তাকে ইদানীং মুখ বুজে অনেক কিছু সইতে হয়। ততক্ষণে ট্রেন চলতে শুরু করে ফুল স্পীডে। ট্রেনের কু-ঝিক-ঝিক কু-ঝিক-ঝিক ছন্দবদ্ধ আওয়াজ আর যাত্রীদের কোলাহলে রুইয়ার কথা ক্রমে ক্রমে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে। ট্রেনের প্রতিটা কামরা মানুষে ঠাঁসা। যাদের সিট নাম্বার আছে তারা টিকেট দেখে দেখে সিট খুঁজছে, কেউবা দাঁড়িয়ে আছে করিডোরে, আবার কেউ দরজায় হেলান দিয়ে। কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর স্টেশন পর্যন্ত ট্রেনে একটু ভিড় থাকবে, দাঁড়ানোদের কেউ কেউ হয়তো নেমে যাবে বিমানবন্দর স্টেশনে, কেউ কেউ অন্য কোন বগিতে সিট ম্যানেজের চেষ্টা করবে। বিমানবন্দর ষ্টেশন পার হলে ৯৭ সিটের পুরো বগিতে নেমে আসবে নীরবতা। শুধু মাঝে মাঝে ক্যান্টিন থেকে রেলওয়ের নির্ধারিত ইউনিফর্মধারী স্টাফদের কেউ চা, কেউ নাস্তার প্যাকেট, কেউ ডালায় সাজানো চকলেট-চিপস নিয়ে আসবে বিক্রি করতে। আর তখন বাইরের প্রকৃতি সাঁই সাঁই করে পাশ কাটিয়ে যাবে ট্রেনকে।

প্রতিটা চেয়ার কোচ এবং ফার্স্ট ক্লাস বগির ঠিক মাঝামাঝিতে বসার আটটা সিট থাকে মুখোমুখি। চার চার সিটের সারি দুই পাশে। মাঝে যাত্রী চলাচলের সরু করিডোর। রইসু একদিকের দুইটা সিট পেয়েছে। তাদের মুখোমুখি সামনের সিটগুলোতে বসে আছে দুইজন যুবক। দুই সারি সিটের মাঝে একটা ছোট্ট চারকোনা ট্রে টাইপ হালকা পাটাতন ট্রেনের বডিতে ঝুলছে। নিচে থেকে ট্রেটা ঠেশ দেয়ার জন্য হাত খানেক লম্বা একটা স্টিলের কাঠিও দোল খাচ্ছে সেই সাথে। আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে দীর্ঘ যাত্রায় চা-নাস্তার জন্য টেবিল হিসাবে ব্যবহৃত হয় কাঠি-পাটাতনের এই সংযোগ। টি-টেবিলের কাজটা দিব্যি হয়ে যায় এতে। ট্রেন ছুটছে। জানালা দিয়ে দুই দিকে যতদূর চোখ যায় আবাদি ফসলী জমি। মাঠ জুড়ে কোথাও কাঁচাপাকা ধানের বিস্তার আবার কোথাও মাইলের পর মাইল হলুদ সরিষার আস্তরণ। ফসলের মাঠ, মাঠে চড়া গবাদিপশু, নদী-নালা-খাল, গাছ-পালা আর রেল লাইনের পাশের বাড়িঘরগুলোকে পেছনে ফেলে ট্রেনটা এগিয়ে যাচ্ছে তীব্র গতিতে সাঁ সাঁ শব্দ তুলে।

রইসু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার দিকে চোখ ফেরায়। রইসু ঠিক মত খেয়াল করেনি মিলিকে। খেয়াল করলেও এতদিন পর তাঁকে চেনার কথা নয়। সামনের সিটে মিলি একজন ভদ্রলোকের পাশে বসে আছে। মিলি চিনতে পারে রইসুকে এবং পাশে বসা ভদ্রলোকের সাথে তাকে পরিচয়ও করিয়ে দেয়।

– আপনি রইসু ভাই না?

– হ্যাঁ, আপনি কে বলছেন প্লিজ?

– আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি মিলি?

– আরে মিলি! তাই’তো, একদম চিনতে পারিনি প্রথমে!

– কত দিন পর দেখছি আপনাকে?

– তুমি কোত্থেকে? একা নাকি?

– আমার স্বামী। পাশে বসা ভদ্রলোককে ইঙ্গিত করে। ভদ্রলোক রইসুর দিকে হাতটা এগিয়ে দিতে দিতে বলেন,

– আমি সুহান, সুহান রাহমান।

– নাইছ টু মিট ইউ। আমার নামটা তো শুনলেন আপনার পত্নীর মুখ থেকেই।

এনিওয়ে, আমি রইসুল আসাদ।

– আমার স্ত্রী, রুইয়া। পাশ ফিরে নিজের স্ত্রীকে পরিচয় করাতে যাবে ঠিক সে সময় দেখা গেল রুইয়া অঘোরে ঘুমাচ্ছে।

– জানো সুহান, রইসু ভাই আমাদের বাড়িতে থেকে কলেজে পরাশুনা করেছেন। কি যে ভালো ছাত্র ছিলেন না উনি, উনার জন্যই তো আমাদের পাস করা হত প্রতিটা পরীক্ষায়। কত্ত বদলে গেছেন রইসু ভাই!

– তাই নাকি রইসু সাহেব?

– আরে না ভাই, মিলি একটু বাড়িয়ে বলছে আরকি। একটু আধটু বাড়িয়ে বলা ওর ছোট বেলার স্বভাব।

– তা ব্যবসা না চাকরি, রইসু সাহেব?

– একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে আছি। ম্যানেজার পোস্টে।

– ভেরি নাইস। ঠিক আছে, তোমরা গল্প কর। এই ফাঁকে আমি একটু ঘুমিয়ে নেই।

মিলিকে কথাগুলো বলেই সুহান রাহমান কানে হেডফোন গুজে চোখ বুজেন। অনেকদিন পর তাদের দেখা, হিসেব করলে বছর বারো তো হবেই। এদিকে রুইয়া ঘুমিয়ে পড়ায় একটু সুবিধাই হয়েছে রইসুর। মিলির সাথে জমিয়ে এবং নিশ্চিন্তে আলাপ করা যাবে।

– কেমন আছেন রইসু ভাই?

– এই তো বেশ আছি। তোমরা আছো কেমন?

– ভালোই আছি।

– তা কোথায় যাওয়া হচ্ছে তোমাদের?

– কক্সবাজার যাচ্ছি। একটু ঘুরতে।

– আমরাও তো কক্সবাজার। বাহ, ভালোই হল তাহলে।

– খুব ভালো হলো। একসাথে ঘুরা যাবে। কত দিন হল বিয়ে করলেন, রইসু ভাই?

– এই তো, বছরের কিছু উপরে হবে। তুমি?

– রিমাবুর বিয়ের পরপরই।

– চা খাবে মিলি?

মিলির উত্তরের অপেক্ষা না করে পাশে দাঁড়ানো ক্যান্টিনবয়কে দুটো চায়ের কথা বলে রইসু। ততক্ষণে রুইয়া জেগে উঠেছে। একটু আগে রুইয়ার ঘুমিয়ে থাকাটা রইসুর জন্য যতখানি স্বস্তির ছিলো, এখন তার জেগে ওঠাটা এর চেয়েও অনেকগুণ বেশি কাঙ্খিত মনে হলো। ঢুলুঢুলু ঘুম চোখে রুইয়া রইসুর দিকে তাকালে মিলির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। স্বামী যাদের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করেছে, তাদের প্রতি স্বাভাবিক একটা কৃতজ্ঞতাবোধ থাকবে স্ত্রীদের আর রুইয়ার এটা আছে শতভাগ। কুশলাদি বিনিময় ছাড়াও অনেক আলাপ হয় দুজনাতে। শ্রেফ সৌজন্যবসত নয়, বেশ আন্তরিকতার সাথে রুইয়া মিলিদের বাড়ির সবার খোঁজ খবর নেয়। এসব কাজে রুইয়া বেশ পারদর্শী। কারো সামনে তাকে দেখলে কখনই বোঝা যাবে না এই মহিলা একলা বাসায় কতটা কর্কশ হতে পারে। জনসম্মুখে রুইয়া কখনো রইসুকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে না এই যা অনেকটা শান্তি। মিলি আর রুইয়া জম্পেশ আড্ডা বসিয়েছে, হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। এদেরকে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না দুজন মাত্র পরিচিত হয়েছে। অবশ্য রইসুর দেখা সব নারীই এমন। কত সহজেই না একে অন্যকে আপন করে নেয়। রইসু ভাবে, মায়ের জাত কিনা তাই!

নিজের মাকে শেষ কবে দেখেছিলো মনে পড়েনা তার। মা চলে যাবার পর শুধু এটুকু জানতো মা বেঁচে আছেন এবং তিনি আর ফিরে আসবেন না। মায়ের সম্পর্কে কাউকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করা নিয়ে বাবার কড়া বারণ ছিলো। আশেপাশের সবাই মার নামে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলতো। অবুঝ রইসু তখনই বুঝে গিয়েছিলো মা ভালো মহিলা ছিলেন না। ভালো মিহিলারা তাদের সন্তানকে ফেলে যায় না কখনো, বাবাকে কষ্ট দেয় না। মা চলে যাবার পর থেকে রইসুর প্রতি চারপাশের সবাই যেন কেমন একটা মায়া মায়া দৃষ্টি নিয়ে তাকাতো। রইসুর ভালো লাগতোনা এই চাহনি। মানুষদের করুণাদৃষ্টি দেখে মার প্রতি একরকম ঘেন্না আসতো তার। ছোট্ট বেলার ওই সময়টায় রইসু প্রতি রাতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতো। রাত গভীর হলে মাঝে মাঝেই দেখতো বাবা বারান্দায় বসে আছেন কিংবা উঠানে পায়চারী করছেন। বড় হবার সাথে সাথে বাবার কষ্টটা কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পেরেছে সে। বাবাও আস্তে আস্তে সয়ে গেছেন সবকিছু, পুরনো ক্ষত। রইসু তার দাদীকেই তো দেখেছে, কত সহজেই না মানুষজনকে আপন করে নিয়েছেন। দাদীর কাছে কেউ কোন কিছুর জন্য আসলে ফিরে যায়নি। সম্পূর্ণ অপরিচিত জনের সাথেও দাদী ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছেন।

– রইসু ভাই, আপনার চা-নাস্তা তো ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। খেয়ে নেন।

– এই তো খাবো। তার আগে রিমার অঙ্কটা দেখে নেই।

– মিলি, তোমার ইংরেজি পড়াটা মুখস্ত হয়েছে?

– না রইসু ভাই, আর একটু সময় লাগবে।

– ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি শেষ করো।

ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রইসু। ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা এক চিলতে হাসি।

– কি হল তোমার, বাইরে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছো যে? মিলি আপা কি বলছে, শুনতে পাচ্ছো? তোমার চা যে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে!

– রইসু ভাই মনে হয় পুরনো দিনে ফিরে গেছেন, ভাবি। উত্তর না দিয়ে মিলির দিকে চেয়ে মুচকি হাসে রইসু। হাসিটা রুইয়ার চোখ ফাঁকি দিতে পারে না। তাই মিলির প্রতিহাসির সাথে যোগ হয় রুইয়ার ছোঁয়াচেহাসি। রইসু একবার মিলিকে, একবার রুইয়াকে দেখে। হাসলে খুব একটা খারাপ দেখায় না রুইয়াকে।

– আপনার রইসু ভাইয়ের আবার পুরনো স্মৃতি! আছে নাকি কিছু?

– ভাই সাহেবের যে ঘুম ভাঙ্গার নামই নেই, মিলি। একটু পরই কিন্তু আমাদের নামতে হবে। জাগিয়ে দেবে নাকি?

কমলাপুরের মত এতটা বিশাল না হলেও প্রায় কাছাকাছি বলা যায় আয়তনে। এখানেও অনেকগুলো ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরপর মাইকে ঘোষণা দিচ্ছে ট্রেনের সময়সূচী। কোনটা প্লাটফর্ম ছেড়ে যাচ্ছে, আবার কোনটা ঢুকছে। যাত্রীরা উঠানামা করছে। হকার কুলিদের চেঁচামেচি আর দর কষাকষি যাত্রীদের সাথে। সব কিছু মিলিয়ে ব্যস্ত ষ্টেশন চট্টগ্রাম। দীর্ঘ জার্নির ক্লান্তি কেটে যায় বাইরের ঝির ঝির বাতাসের স্পর্শে। বুঝিবা সমুদ্রের নোনা বাতাস এখানেও। যার যার সুবিধামত পরিবহন আগে থেকেই ঠিক করে রাখা ছিল। কক্সবাজারে দেখা হবে বলে এখানে বিদায় নেয় মিলিরা।

– আব্বা আমাদের এই বিয়ে মেনে নেবে না বলে দিয়েছে।

– কেন মেনে নেবেন না, বল তো? আমার কোন অপরাধ?

– অপরাধ তোমার না, অপরাধ তোমার মায়ের। কি দরকার ছিলো সংসারে একটা ছোট্ট ছেলে আর স্বামীকে ফেলে রেখে অন্য পুরুষের হাত ধরে পালিয়ে যাবার?

– আমি কি করে জানবো, বলো! মায়ের দেখাই তো পাইনি কোন দিন। পেলে না হয় জিজ্ঞেস করতাম। আর তুমি তো সব জানো। জেনে শুনেই আমাকে ভালোবেসেছো।

– হা বেসেছি, কিন্তু আব্বার মতের বাইরে আমি কিচ্ছু করতে পারবো না, এটা আমার শেষ কথা। আমি এখন যাচ্ছি।

রইসু অনেকক্ষণ বসে ছিলো পুকুর ঘাটে। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসা সান্ধ্য ধুয়াশারা সেদিন রইসুর মনের চারদিকে ভীর করেছিলো। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়, ও’বাড়িতে আর ঢুকবে না সে। হাঁটা দেয় স্টেশনের দিকে। স্টেশনের দূরত্ব কমার সাথে সাথে পেছনের দূরত্ব বাড়তে থাকে সমান হারে। একসময় দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে যায় ফেলে আসা সব অতীত। মোষের মত পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছ, আর ওদিকে সূর্য যে মাথার উপর ভাসতে চললো। সী-বিচে যাবা কখন? কি হল, ওঠ? অঘোর ঘুমে রাতটা কোন দিক দিয়ে কেটে গেলো টের পায়নি রইসু। মাঝ রাতে একটু জেগে উঠেছিলো, রুইয়া শরীরের সাথে মিশে কি যেন খুঁজছিল যত্রতত্র। রইসু বুঝেও সায় দেয়নি। ক্লান্তিতে অবসন্ন ছিলো তার কামধেনু। পরে রুইয়া ক্ষান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেয়। সূর্যটা বরাবরই একটু বেশি তেজি হয়ে ওঠে এখানে। এর আগেও কয়েকবার বন্ধুদের সাথে কক্সবাজার সৈকতে ঘুরতে এসেছে রইসু। একই অবস্থা দেখেছে সব সময়। এখন পর্যটন মৌসুম। শ’য়ে শ’য়ে পর্যটক এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করছে। হোটেল থেকে বেরিয়ে রইসু আর রুইয়া লাবনী পয়েন্টের দিকে হাঁটা দেয়। রইসুর কেন যেন আজ পানিতে নামার ইচ্ছে হয় না। রুইয়া একাই পানির দিকে এগিয়ে যায়, রইসু দাঁড়িয়ে থাকে একরাশ বালির মধ্যে। এদিক সেদিক তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজছে। সে কি মিলিকে খুঁজছে? বুঝতে পাড়ে না। একসময় রুইয়ার আহ্লাদে পানিতে নামতে হয় রইসুকে। সী-বীচে ঘণ্টা তিনেক কাটিয়ে হোটেলে ফিরে ওরা।

সন্ধ্যায় যখন সূর্যাস্ত দেখবে বলে রইসু বের হয় রুইয়া তখন ক্লান্তির গভীর ঘুমে। লাবনী পয়েন্টের একেবারে শেষ দিকে একটা চেয়ার ভাড়া করে আধশোয়া অবস্থায় ডুবতে থাকা সূর্যের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে নিজের জীবনসূর্যের দিকে তাকায় রইসু। হায় সেখানেও কি আজ সূর্যের আসন্ন ডুবি!

– রইসু ভাই, একা যে? ভাবি কোথায়?

– আরে মিলি! তোমার ভাবি ঘুমাচ্ছে। তা সুহান সাহেবকে কোথায় রেখে এলে? দেখছি না যে?

– ওই একই, ঘুমাচ্ছে। আমার আবার এই সাঁঝসন্ধ্যায় ঘুমাতে ভালো লাগেনা। তাই একটু হাঁটতে বের হলাম।

– সূর্যাস্তটা অনেক সুন্দর এখানে। দেখার মত।

– রক্তিম রক্তিম, সিদুরলাল আভা ছড়ানো।

– বাহ, বেশ বলেছো তো!

– আচ্ছা রইসু ভাই, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? ঠিক ঠিক উত্তর দেবেন তো?

– বল, কি কথা? নিশ্চয়ই উত্তর দেব।

– আপনার সাথে ট্রেনে এত্ত এত্ত কথা হল অথচ একবারও তো আপনি রিমাবুর কথা জিজ্ঞেস করলেন না?

– পুরনো ক্ষত যত কম চুলকানো যায় ততই ভালো। বিজ্ঞদের কথা। বুঝলে? হা হা হা।

– আপনি এখনো রিমাবুর উপর রেগে আছেন। সে রাতে আমরা আপনাকে অনেক খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও পাইনি। ভাগ্যের কি পরিহাস দেখেন, আপনাকে যখন ভুলতে বসেছি তখনই আবার দেখা পেলাম। আজ আপনি আমি একেলা এই নির্জনে।

– তাও নিয়তির অমোঘ বিধান। দুজনেই নিরব কিছুটা সময়। বেলা-অবেলার দুলাচলে যেন দুজনে এই বেলাভূমিতে কথার সাতকাহন খুঁজে ফিরছে। পাওয়া মাত্রই আবার মেতে উঠবে কলকলিয়ে।

– রিমাবু কত বড় সেক্রিফাইস করেছিলো জানেন না আপনি। সময়ে আমিও তাকে বুঝতে পারিনি। এখন তার জন্যও কষ্ট হয়।

– আমাকে এখন আর ওসব শুনিয়ে লাভ কি? আমি বিবাহিত। আপন জগত নিয়ে খুব সুখে আছি।

– আপনি সুখে নেই, আমি জানি। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে কেউ কোন দিন সুখী হতে পারেনা। হারানো ভালোবাসা মানেই একটা গভীর ক্ষত।

– বাহ, অনেক দার্শনিক কথাবার্তা বলছ যে! তা তুমিও কি কাউকে ভালবেসে হারিয়েছো নাকি?

– হুম। হারিয়েছি। ভালোবাসার অনিষিক্ত কুড়ি থেকে এখনো বেদনাকষ ঝরছে। জানতে চান সে কে?

– আমার চেনা পরিচিতের মধ্যে হলে বল।

– আপনার চেনা রইসু ভাই। খুব চেনা।

– শুনি তাহলে।

– যদি বলি আপনি?

মাঝে মাঝে কান ভুল করে। এমনটা হয়নি তো? রইসু আবার জিজ্ঞেস করে শুনতে চায়। একই কথা বলে মিলি। ভাবতে গিয়ে সব কেমন ঘুলিয়ে ফেলে রইসু।

– আমাকে ভালোবাস সেটা তো কখনো বলনি?

নিস্তব্ধ নীরবতা চারদিকে। জনমানব আর যান্ত্রিক কোলাহল অনেকটা দূরে সরে গেছে ওদের দুজন থেকে। অদূর সমুদ্দুরে ভাসছে শতশত জেলে নৌকা আর পিদিমের মত পিটপিট আলো ছড়াচ্ছে হ্যাজাক বাতিগুলো। শুধু জেগে থাকছে বাতাসের তীব্র ঝাপটা, বালিতে ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ। রইসু অনেকটা অন্যমনস্ক। কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ রইসুর বুকে ঝাপিয়ে পরে মিলি, ঢেউয়ের মত। জড়িয়ে ধরে পরাশ্রয়ী স্বর্ণলতিকার স্বভাবে, আষ্টেপৃষ্ঠে। রইসুর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট জোড়া বসিয়ে দিতে দিতে পাগলের মত জাপটাতে থাকে।

– এ কি হচ্ছে মিলি? এটা একেবারেই ঠিক হচ্ছে না কিন্তু! ছাড় বলছি।

– না ছাড়বো না। আমি আপনাকে এখনো ভালোবাসি, আগের মতই পেতে চাই। ছুটন্ত ট্রেনে উঠার সময় পা ফসকে পরে যেতে যেতেও কোন রকমে বেঁচে যাওয়া রইসু যেন সওয়ার হয় এক আজব ট্রেনে। গতকাল রাতে রুইয়ার ডাকে সাড়া না দেওয়া কামধেনু এখন রইসুর সারা অঙ্গে জোয়ার তোলে। রইসু উদগত হয় মিলি’তে। চারপাশের বাতাসে সুর উঠে কু-ঝিক-ঝিক কু-ঝিক-ঝিক কু-ঝিক-ঝিক।