ভুয়া তান্ত্রিকের ফাঁদ

ভুয়া তান্ত্রিকের ফাঁদ

ফরিদগঞ্জে এক রিকশাচালক হঠাৎ করে হয়ে গেছে বড় তান্ত্রিক। ভুয়া তন্ত্র-মন্ত্র, তেলপড়া, সুতাপড়া, পানিপড়া দিয়ে গ্রামের সহজ-সরল শিশু-কিশোর-নারী-পুরুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। অন্ধ বিশ্বাসের ওপর ভর করে প্রতিদিন তার বাড়িতে ভিড় করছে শিশু-কিশোরসহ শত শত নারী-পুরুষ। সুযোগ পেয়ে মকবুল আহম্মদ নামের ওই ভুয়া তান্ত্রিক প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা।

তাকে কেন্দ্র করে গত প্রায় দেড় মাসে এক শ্রেণির দালাল চক্র গড়ে উঠেছে সেখানে। দালালরা তাকে বেষ্টনী দিয়ে রাখে। এ ভুয়া তান্ত্রিকের কাছে গেলে সর্ব রোগ-শোক থেকে পরিত্রাণ পাবে বলে তারা প্রচার করছে। উপজেলার ১২নং চরদুখিয়া ইউনিয়নের চরচন্না গ্রামে গত প্রায় দেড় মাস যাবত চলছে প্রতারণামূলক ভুয়া তান্ত্রিক ব্যবসা। সরজমিনে জানা গেছে, গ্রামের রাঢ়ী বাড়ির দরিদ্র পরিবারের ছেলে মুকবুল আহম্মদ (৩৮)। দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া করা হয়নি তার। তাই কিশোর বয়সেই ক্ষেতমজুর, নির্মাণ শ্রমিক এর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। এক পর্যায়ে গত প্রায় ১৫ বছর পূর্বে চলে যান ঢাকা শহরে। বিভিন্ন কাজে শ্রম বিক্রিসহ ইক্ষু বিক্রি করেছেন।

প্রায় ১২ বছর শহরের বিভিন্ন স্থানে রিকশা চালিয়েছেন তিনি। এদিকে, হঠাৎ করেই গত প্রায় দেড় মাস পূর্বে এলাকায় আবির্ভাব ঘটে মুকবুল আহম্মদের। তন্ত্র-মন্ত্র দিয়ে তিনি নানা জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা করেন। চিকিৎসায় ভালো হয়েছেন অনেকে। কে বা কারা এলাকায় তার এমন ভুয়া সংবাদ প্রচার করে দেয়। প্রতিদিন তার বাড়িতে শতাধিক শিশু-কিশোর ও নারী-পুরুষের যাতায়াত শুরু হয়। সকাল হতে রাত অবধি ভিড় লেগে থাকে বাড়িতে। আরোগ্য লাভের আশায় দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই তার বাড়িতে যান। প্রতিদিন ৫০-৬০ জনকে শিরনি পাক করে খাওয়ান তিনি। তার ভাষায় এটা হচ্ছে তবারক। লোকমুখে খবর পেয়ে এ প্রতিবেদকসহ কয়েকজন সাংবাদিক যান তার বাড়িতে। বেলা ২টায় সেখানে গিয়ে দেখা যায় তিনি তেল, কালো সুতা, পানি, পিয়াজপড়া ও ঝাড়ফুঁক দিচ্ছেন লোকজনকে। বিনিময়ে ১০১ থেকে ৫০১ টাকা নিচ্ছেন। আরোগ্য লাভের আশায় তার কাছে যারা গেছেন, তাদের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় হাত-পায়ে, বুকে-পিঠে ব্যথা, হাড় ভাঙাসহ হাঁটুর বাটি ভেঙে যাওয়া রোগী যেমন আছে। তেমন আছে নাকের পলিপাসের রোগী। ভূতে ধরা, বুক ও পেটের ব্যথা, মাথা ঘুরানো, মানুষ হারিয়ে যাওয়া, স্বামী-স্ত্রীর অমিলসহ পারিবারিক অশান্তির সমাধানও দেন তিনি। শতাধিক মানুষের সামনে কথা হয় তার সঙ্গে। তার এমন তান্ত্রিক হয়ে উঠার রহস্য জানতে চাইলে তিনি জানান, ঢাকা শহরে রিকশা চালাতে গিয়ে গত রমজান মাসে দেখা হয় এক অলি বাবার সঙ্গে।

ওই অলি বাবা তাকে বিভিন্ন সময় নানা পরীক্ষায় ফেলেন। কয়েক মাস চলার পর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় মুকবুল আহম্মদ। এরপর এলাকায় গিয়ে মানুষের সেবা করার জন্য অলি বাব তাকে নির্দেশ দেন। সে মোতাবেক মুকবুল আহম্মদ চলে যান নিজ গ্রামের বাড়িতে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় অলি বাবার নাম কি।

উত্তরে মুকবুল আহম্মদ বলেন তার নাম ‘বাকী শুদ্ধ অলি’! মুকবুল আহম্মদ বলেন, আমার কাছে এসে কেউ খালি হাতে ফিরেনি। তিনি দাবি করেন, গত চার মাস পূর্বে প্রায় ৭ দিন যাবত আকাশে মেঘ। বাড়ির ধান শুকাতে পারছে না। তার ধ্যানে মেঘ কেটে যায়। আকাশে রোদ ওঠে। ধান শুকিয়ে ভাঙানো হয়। 

নাকে পলিপাস নিয়ে তার কাছে চিকিৎসা নিতে গেছেন চরচন্না গ্রামের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সোমা ও নওশিন নামের পাঁচ বছরের এক শিশু। নাকের পলিপাসের জন্য তাদের তেল, পিয়াজ ও কালো সুতাপড়া দেয়া হয়েছে। এছাড়া, উপস্থিত রফিক (৪০), সিরাজ (৬০), আরিফ (২৯), সালমা বেগম (২৩), ইয়াছিন (২৩)সহ বেশ কয়েকজনের সামনে জানান, ভূতে ধরাসহ তাদের শারীরিক নানা সমস্যা নিয়ে মুকবুল আহম্মদের কাছে গিয়ে তারা চিকিৎসায় আরোগ্য লাভ করেছেন। এদের পরিচয় সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেছে, এরা অধিকাংশ মুকবুল আহম্মদের কাছের ও দূরের আত্মীয়-স্বজন। অন্যদিকে উপস্থিত মো. সেলিম (৫৫) জানান, মুকবুল আহম্মদের প্রতিবেশী মো. টেলু রাঢ়ীর পোলিও রোগাক্রান্ত শারীরিক প্রতিবন্ধী মো. হাছান (১৪)কে গত এক মাস যাবত চিকিৎসা দিচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। একই ভাবে এমরান হোসেন (৩০), রাকিব মজুমদার (১৬), সবুজ (৩৮), আ. গফুর (২২) হিরামন মজুমদার (২১) প্রমুখ অভিযোগ করেন, মুকবুল আহম্মদ তান্ত্রিকতার নামে গত প্রায় দেড় মাস ধরে এলাকায় এই ভুয়া চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার চিকিৎসায় কেউ ভালো হয়েছে- এমন কোনো সংবাদ জানা যায়নি।  তারা জানান, সরকারের দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে। এ বিষয়ে ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও প.প. কর্মকর্তা শিপন জাহাঙ্গীর বলেন, নিঃসন্দেহে এটি একটি ধোঁকাবাজি।