কি ভাবে আয়কর দিবেন, নিজেই দিন আয়কর

কি ভাবে আয়কর দিবেন, নিজেই দিন আয়কর

এক পৃষ্ঠার ফরম পূরণ করেই এবার আয়কর বিবরণী জমা দেওয়া যাবে। প্রথমবারের মতো এক পৃষ্ঠার ফরম চালু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এক পৃষ্ঠায় সব তথ্য দিতে হবে। আয় যদি বছরে চার লাখ টাকার কম হয়, তাহলে এক পৃষ্ঠার আয়কর রিটার্ন ফরম পূরণ করতে হবে, তবে সম্পদের পরিমাণ ৪০ লাখ টাকার কম হতে হবে। এর ফলে লাখ লাখ ছোট করদাতার জন্য বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমা দেওয়া সহজ হয়ে গেল।

 

চলতি অর্থবছর থেকে এমন স্বল্প আয়ের করদাতাদের জন্য প্রথমবারের মতো এমন ঝক্কিঝামেলাহীন রিটার্ন ফরম প্রবর্তন করেছে এনবিআর।

 

৩০ নভেম্বরের মধ্যে এই এক পৃষ্ঠার ফরম পূরণ করে বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমা দিলেই চলবে। খুব বেশি তথ্যও দিতে হবে না। এক পৃষ্ঠার ফরমে করদাতার ছবি, নাম, কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন), কর অঞ্চল সার্কেল, বর্তমান স্থায়ী ঠিকানা দিতে হবে। ছাড়া করযোগ্য আয়ের পরিমাণ করের পরিমাণ লিখতে হবে। লিখতে হবে সম্পদের পরিমাণ আয়ের উৎস। ছাড়া আপনি যে ব্যাংক চালানের মাধ্যমে কর দিচ্ছেন, তার নম্বর দিতে হবে। এই অল্প কিছু তথ্য দিয়েই আপনি রিটার্ন ফরম পূরণ করতে পারবেন। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে হয়ে যাবে ফরম পূরণ।

 

তবে বার্ষিক আয় চার লাখ টাকার কম হলে কিংবা ৪০ লাখ টাকার কম সম্পদ থাকলেও কোনো করদাতার যদি একটি গাড়ি থাকে, কিংবা সিটি করপোরেশন এলাকায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট থাকে, তাহলে তাঁদের জন্য এক পৃষ্ঠার ফরম প্রযোজ্য হবে না। তাঁদের সেই পুরোনো ফরমে রিটার্ন দিতে হবে।

 

গত জুন মাসে বাজেট ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল স্বল্প আয়ের করদাতাদের জন্য এক পৃষ্ঠার ফরমের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরেই এক পৃষ্ঠার ফরম প্রকাশ করে এনবিআর।

 

আয়কর বিবরণীয়র সনাতনী বিশাল ফরমের কারণে অনেকে কর দিতে চান না। ফরম পূরণও বেশ জটিল। তাই নতুন এক পৃষ্ঠার ফরম প্রবর্তন হওয়ায় স্বল্প আয়ের করদাতাদের জন্য সুবিধা হলো। দীর্ঘদিন ধরেই রিটার্ন ফরম সহজ করার জন্য দাবি করে আসছিলেন করদাতারা।

 

বাংলাদেশে বর্তমানে ৪৫ লাখের বেশি কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। প্রতিবছর ২২ থেকে ২৩ লাখ টিআইএনধারী রিটার্ন দেন। চলতি বছর থেকে কিছু শর্ত সাপেক্ষে সব টিআইএনধারীর রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

 

এনবিআরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত চলতি অর্থবছরের আয়কর পরিপত্র নির্দেশিকায় এক পৃষ্টার ফরম আছে। সেখান থেকে প্রিন্ট নিয়ে তা পূরন করে জমা দিলেই হবে। আবার প্রতিটি কর অঞ্চলে ইতিমধ্যে কর মেলার আদলে ওয়ানস্টপ সেবা চালু করেছে। সেখানেও করদাতাদের জন্য বিনামূল্যে এক পৃষ্টার ছাপানো ফরম বিতরণ করা হচ্ছে।

 

চাকরিজীবীরা যেভাবে আয়করের হিসাব করবেন

বাংলাদেশে যত করদাতা আছেন, তাঁদের একটি বড় অংশ চাকরিজীবী। করযোগ্য আয় থাকুক আর না থাকুক, নির্বাহী পর্যায়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের তাঁদের প্রতিবছরই বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমা দিতে হয়। করের হিসাব-নিকাশ করা কিছুটা জটিল। কর ছাড়ের হিসাবও বিবেচনায় রাখতে হবে। কিন্তু একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চাকরিজীবী কীভাবে কর ঠিক করবেন, তা এবার দেখা যাক।

 

একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে চাকরি করেন কামরুন নাহার। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে মূল বেতন ৫০ হাজার টাকা, চিকিৎসা ভাতা হাজার টাকা, বাড়িভাড়া ভাতা ২০ হাজার টাকা, যাতায়াত সুবিধার হাজার টাকা এবং বছরে দুটি উৎসব বোনাস (দুটি মূল বেতন) লাখ টাকা পেয়েছেন। এই বাইরে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য তিনি অফিস থেকে একটি গাড়ি বরাদ্দ পেয়েছেন। ছাড়া বেতন-ভাতার বাইরে বছরজুড়েই অন্য খাতে বাড়তি কিছু আয়ও করেছেন তিনি। যেমন গৃহসম্পত্তি থেকে ৫০ হাজার টাকা, আইসিবি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে লভ্যাংশ হিসেবে ৩০ হাজার টাকা এবং ব্যাংক সুদ ১০ হাজার টাকা পেয়েছেন। লভ্যাংশ ব্যাংক সুদ তোলার সময় ১০ শতাংশ উৎসে কর কেটে রাখা হয়েছে। ছাড়া কামরুন নাহার এক লাখ টাকার তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র কিনেছেন।

 

তাহলে এবার দেখা যাক, কামরুন নাহারের কত করযোগ্য আয় হলো। মূল বেতন (১২ মাসের মূল বেতন) লাখ টাকা এবং উৎসব বোনাস এক লাখ টাকা পেয়েছেন। ছাড়া বছরজুড়ে চিকিৎসা ভাতা হিসেবে পাওয়া ২৪ হাজার টাকার পুরোটাই করমুক্ত। কারণ, চিকিৎসা ভাতা হিসেবে মূল বেতনের ১০ শতাংশ পর্যন্ত বা বছরে লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে যেটি কম হবে, সেই টাকার ওপর কর ছাড় মেলে। ১২ মাসে বাড়িভাড়া হিসেবে পেয়েছেন মোট লাখ ৪০ হাজার টাকা।

 

চিকিৎসা ভাতার মতো বাড়িভাড়ায় কর ছাড় পাবেন কামরুন নাহার। বছরে লাখ টাকা বা মূল বেতনের ৫০ শতাংশের মধ্যে যেটি কম। সেই হিসাবে বাড়িভাড়ার ওপরও কর বসবে না। ছাড়া যাতায়াত সুবিধা হিসেবে মাসে হাজার টাকা করে ৬০ হাজার টাকা করযোগ্য আয়ে যোগ হবে।

 

সব মিলিয়ে কামরুন নাহারের বেতন খাতে আয় দাঁড়াবে লাখ ৬০ হাজার টাকা। এরবাইরে গৃহসম্পত্তি থেকে ৫০ হাজার টাকা, কৃষি খাতের ১০ হাজার টাকা, ব্যাংক সুদ ১০ হাজার টাকাও যোগ হবে। পাশাপাশি আইসিবি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে লভ্যাংশ হিসেবে পাওয়া মাত্র হাজার টাকা যোগ করতে হবে।

 

কারণ, এই খাতে বিনিয়োগের জন্য বছরে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত রেয়াত পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে করযোগ্য আয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এই আয়ের প্রথম সাড়ে তিন লাখ টাকার ওপর কোনো কর বসবে না। পরবর্তী এক লাখ টাকার জন্য শতাংশ হারে কর বসবে। পরের তিন লাখ টাকার জন্য ১০ শতাংশ এবং পরবর্তী ৮৫ হাজার টাকার ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর বসবে। সব মিলিয়ে কামরুন নাহারের করের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৭ হাজার ৭৫০ টাকা।

 

কামরুন নাহার যেহেতু সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন, তাই বিনিয়োগ কর রেয়াত পাবেন। মোট আয়ের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত, অর্থাৎ লাখ হাজার ৭৫০ টাকা পর্যন্ত অনুমোদনযোগ্য বিনিয়োগ। কিন্তু কামরুন নাহারের বিনিয়োগ এই সীমা ছাড়ায়নি। তাঁর বিনিয়োগের পরিমাণ এক লাখ টাকা। তাই বিনিয়োগের ১৫ শতাংশ মানে, ১৫ হাজার টাকা কর রেয়াত পাবেন। ছাড়া মিউচুয়াল ফান্ডের লভ্যাংশ ব্যাংক সুদের হার তুলে নেওয়ার সময় সব মিলিয়ে হাজার টাকা কেটে রাখা হয়েছিল।

 

তাই বার্ষিক রিটার্ন দিয়ে কর দেওয়ার সময় বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত উৎসে কর হিসেবে কেটে নেওয়া টাকা বাদ দিতে হবে। সেই হিসাবে বাদ যাবে ১৯ হাজার টাকা। বছর শেষে কামরুন নাহারকে ২৮ হাজার ৭৫০ টাকা দিতে হবে।

 

আয়কর রিটার্ন যাঁদের দিতেই হবে 

আয়কর কর্তৃপক্ষের কাছে করদাতার বার্ষিক আয়, ব্যয় সম্পদের তথ্য নির্ধারিত ফরমে উপস্থাপন করার মাধ্যম হচ্ছে আয়কর রিটার্ন। আয়কর আইন অনুযায়ী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্ধারিত ফরমে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয়। কারা আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন:

 

. যাঁদের করযোগ্য আয় রয়েছে, যেমন কোনো ব্যক্তি-করদাতার আয় যদি বছরে লাখ টাকার বেশি হয়; মহিলা এবং ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের করদাতার আয় যদি বছরে সাড়ে লাখ টাকার বেশি হয় এবং গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতার আয় যদি বছরে লাখ ৭৫ হাজার টাকার বেশি হয়।

 

. যাঁদের অবশ্যই রিটার্ন দাখিল করতে হবে:

. যাঁর ১২ ডিজিটের টিআইএন আছে;

. করদাতার মোট আয় করমুক্ত সীমা অতিক্রম করলে;

. আয় বছরের পূর্ববর্তী তিন বছরের যেকোনো বছর করদাতার কর নির্ধারণ হয়ে থাকলে;

. করদাতা যদি কোনো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডারের এমপ্লয়ি বা কর্মচারী হন;

. করদাতা যদি কোনো ফার্মের অংশীদার হন;

. করদাতা যদি সরকার অথবা সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ, করপোরেশন, সত্তা বা ইউনিটে বা প্রচলিত কোনো আইন, আদেশ বা দলিলের মাধ্যমে গঠিত কোনো কর্তৃপক্ষ, করপোরেশন, সত্তা বা ইউনিটের কর্মচারী হয়ে আয় বছরের যেকোনো সময় ১৬ হাজার টাকা বা এর বেশি মূল বেতন পান;

. করদাতা যদি কোনো ব্যবসায় বা পেশায় নির্বাহী বা ব্যবস্থাপনা পদে বেতনভোগী কর্মী হন;

. করদাতার আয়কর অব্যাহতি পাওয়া বা হ্রাসকৃত হারে করযোগ্য হয়ে থাকে;

. করদাতা যদি মোটর গাড়ির মালিক হন (মোটর গাড়ি বলতে জিপ বা মাইক্রোবাসকেও বোঝাবে);

১০. করদাতা যদি কোনো সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ হতে ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করে কোনো ব্যবসা বা পেশা পরিচালনা করেন

১১. করদাতার যদি মূল্য সংযোজন কর আইনের অধীন নিবন্ধিত কোনো ক্লাবের সদস্যপদ থাকে

১২. করদাতা যদি চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, প্রকৌশলী, স্থপতি অথবা সার্ভেয়ার হিসেবে বা সমজাতীয় পেশাজীবী হিসেবে কোনো স্বীকৃত পেশাজীবী সংস্থার নিবন্ধিত হন;

১৩. করদাতা যদি আয়কর পেশাজীবী হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিবন্ধিত হন;

১৪. করদাতা যদি কোনো বণিক বা শিল্পবিষয়ক চেম্বার বা ব্যবসায়িক সংঘ বা সংস্থার সদস্য হন;

১৫. করদাতা যদি কোনো পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের কোনো পদে বা সাংসদ পদে প্রার্থী হন;

১৬. করদাতা যদি কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা কোনো স্থানীয় সরকারের কোনো টেন্ডারে অংশগ্রহণ করেন;

১৭. করদাতা যদি কোনো কোম্পানির বা কোনো গ্রুপ অব কোম্পানিজের পরিচালনা পর্ষদে থাকেন;

১৮. করদাতা যদি মোটরযান, স্পেস বা স্থান, বাসস্থান অথবা অন্যান্য সম্পদ সরবরাহের মাধ্যমে শেয়ারড ইকোনমিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন; এবং

১৯. করদাতা যদি লাইসেন্সধারী অস্ত্রের মালিক হন।

 

তবে বাংলাদেশে স্থায়ী ভিত্তি নেই এমন অনাবাসী এবং যাঁরা কেবল জমি বিক্রি করতে বা ক্রেডিট কার্ড নিতে ১২ ডিজিটের টিআইএন নিয়েছেন, কিন্তু করযোগ্য আয় নেই, তাঁদের রিটার্ন দিতে হবে না।