ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ডায়েট

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ডায়েট

ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অনিয়ন্ত্রিত জীবন ব্যবস্থাই মূলত এর জন্য দায়ী। এই রোগের রোগীদের রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে। তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডায়েট ওষুধের সঙ্গে সমান জরুরি নিয়মিত ব্যায়াম। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকলে করোনায় সাধারণ হামলাও প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। যাদের ডায়াবেটিস, হৃদরোগ রয়েছে তাদের আগে থেকেই সাবধানে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। আর এর জন্য বাড়িতে তুলতে হবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।

 

চিকিৎসকের মতে, আমরা যখন কোন খাবার খাই তখন আমাদের শরীর সেই খাদ্যের শর্করাকে ভেঙে চিনিতে (গ্লুকোজ) রুপান্তরিত করে। অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নামের যে হরমোন নিসৃত হয়, সেটা আমাদের শরীরের কোষগুলোকে নির্দেশ দেয় চিনিকে গ্রহণ করার জন্যে। এই চিনি কাজ করে শরীরের জ্বালানী বা শক্তি হিসেবে।

 

শরীরে যখন ইনসুলিন তৈরি হতে না পারে অথবা এটা ঠিক মতো কাজ না করে তখনই ডায়াবেটিস হয়। এবং এর ফলে রক্তের মধ্যে চিনি জমা হতে শুরু করে।

 

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার জন্য পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। যারা সুগারের রোগী তাদের অনেক খাবারেই নিষেধাজ্ঞা থাকে। তাই যাদের সুগার রয়েছে এই করোনাকালে তারা কোন খাবারে নিজেদের সুরক্ষিত রাখবেন দেখে নিন।

 

ডায়াবেটিস যদিও জেনেটিক এবং আপনার জীবন যাপনের স্টাইলের ওপর নির্ভরশীল তারপরেও আপনি চেষ্টা করলে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারেন।

 

সেজন্যে আপনাকে খাবার গ্রহণের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে এবং আপনাকে হতে হবে অত্যন্ত সক্রিয় একজন মানুষ। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

 

প্রক্রিয়াজাত খাবার পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। মৃসন শাদা আটার রুটির পরিবর্তে খেতে হবে ভুষিওয়ালা আটার রুটি। এটাই প্রথম ধাপ

 

এড়িয়ে চলতে হবে হোয়াইট পাস্তা, প্যাস্ট্রি, ফিজি ড্রিংকস, চিনি জাতীয় পানীয়, মিষ্টি ইত্যাদি।

আর স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে রয়েছে শাক সব্জি, ফল, বিন্স এবং মোটা দানার খাদ্য শস্য।

স্বাস্থ্যকর তেল, বাদাম খাওয়াও ভালো। ওমেগা থ্রি তেল আছে যেসব মাছে সেগুলো বেশি খেতে হবে। যেমন সারডিন, স্যামন এবং ম্যাকেরেল।

 এক বেলা পেট ভরে না খেয়ে পরিমানে অল্প অল্প করে বিরতি দিয়ে খাওয়া দরকার।

শরীর চর্চ্চা বা ব্যায়াম করার মাধ্যমে রক্তে চিনির মাত্রা কমিয়ে রখা সম্ভব।

চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতি সপ্তাহে আড়াই ঘণ্টার মতো ব্যায়াম করা দরকার। তার মধ্যে দ্রুত হাঁটা এবং সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠাও রয়েছে।

যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তারা ভাত, রুটি, মুড়ি ইত্যাদির পরিমাণে রাশ টানুন। ফল, সবজি বেশি করে খান। এছাড়াও আরও যা মেনে চলবেন-

বাড়ির খাবার খান। ঘুম থেকে ওঠার এক ঘন্টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সারুন। এছাড়াও তিন থেকে চার ঘন্টা অন্তর খাবার খান। যাদের সুগার থাকে তাদের খালি পেটে একদমই থাকা উচিত নয়। কার্বোহাইড্রেট মেপে খান। লাঞ্চ বা ডিনার স্কিপ করবেন না। সেই সঙ্গে তিনটে স্ন্যাকস অবশ্যই খান।

 

মেনুতে বেশি পরিমাণে শস্যদানা রাখুন। গম, যব, তিসি, ডাল ইত্যাদি। এগুলো থেকে আপনি প্রচুর পরিমাণে এনার্জি পাবেন। এছাড়াও দেহের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ পাবেন এই শস্যদানা থেকেই। যা রক্তের শর্করাকে রাখবে নিয়ন্ত্রণে।

 

সুস্থ থাকার জন্য প্রোটিন খুব জরুরি। তাই রাজমা, ছানা, দুধ, মুরগির মাংস, কুসুম ছাড়া ডিম এসব রাখুন খাদ্য তালিকায়। চর্বি নেই এমন মাছও থাকুক। ইলিশ, চিতল, শঙ্কর মাছ এড়িয়ে চলুন। একদম লো ফ্যাট দুধ, টকদই এসব খান। লেটুস খান। প্রোটিন খেলেই শরীর থাকবে সুস্থ। বাড়িতে পাটা টকদই কিন্তু সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে দারুণ ভাবে সাহায্য করে।

 

খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণে সবজি আর ফল রাখুন। কারণ সবজির মধ্যে থাকে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। অহেতুক দামি ফল কিংবা সবজি নয়। বাজারে যা পাওয়া যাচ্ছে তাই খান। কিউই, ড্রাগন ফ্রুট এসবের দিকে ঝুঁকবেন না। ফল সবজিতে থাকে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার। যার ফলে সুগারের মাত্রাও থাকে নিয়ন্ত্রণে।

 

সুস্থ থাকতে বাদাম তেল, তিসির তেল, সূর্যমুখীর তেল, রাইস ব্র্যান অয়েল এসব খাওয়ার চেষ্টা করুন। এদের মধ্যে স্যাচুরেটেড ফ্যাট আর কার্বোহাইড্রেটস থাকে। যা ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণে রাখে। সপ্তাহে তিনদিন আমন্ড, ওয়ালনাট এসব মিশিয়ে খান। এতে সুস্থ থাকবে হার্টও।

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, শরীরে চর্বির পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে ইনসুলিনের কাজ ব্যাহত হয়। তখন রক্তে শর্করার পরিমাণ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। তাই চর্বি ঝরানোর জন্য কার্ডিয়োভাস্কুলার এক্সারসাইজ করতে হবে। আর কখন ব্যায়াম করছেন, সেটাও জরুরি। অনেকেই ঘুম থেকে উঠে দৌড়তে চলে যান। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। ডায়াবেটিক রোগীদের মর্নিং ওয়াক বা খালিপেটে দৌড়ানো উচিত নয়।

 

ব্লাড সুগার পরীক্ষায় সব সময়ে ফাস্টিংয়ের চেয়ে পিপি রিপোর্টে সুগার লেভেল বেশি আসে। কারণ, খাবার খাওয়ার পরে তার শর্করা শরীর কত তাড়াতাড়ি ভাঙতে পারছে এবং রক্তে পৌঁছচ্ছে, তার উপরেই শরীরের সুস্থতা নির্ভরশীল। তাই কিছু খেয়ে ব্যায়াম শুরু করুন, খালি পেটে নয়। বিকেলে হাঁটতে পারেন। ব্রেকফাস্টের কিছুক্ষণ পরে শুরু করা যায় ব্যায়াম।

 

এমন ব্যায়াম করতে হবে যাতে ঘাম ঝরবে। তবেই লাভ হবে। সাধারণত সপ্তাহে ১৫০ মিনিট ব্যায়াম করার কথা বলা হয়। সপ্তাহে সাত দিনে ভাগ করলে প্রত্যেক দিন ২০-২৫ মিনিট। তবে ডায়াবেটিসের ধরন ব্লাড সুগারের মাত্রার উপরে সময়ের ওঠানামা করে। তবে যেসব ব্যায়ামে উপকার পাবেন|

 

কার্ডিয়ো ব্যায়াম

লাইট জগিং: বাড়ির ছাদে বা সামনে মাঠ থাকলে সেখানে কম গতিতে বেশিক্ষণ ধরে লাইট জগিং করতে পারেন।

 

সাঁতার: এর কোনও জুড়ি নেই। যদিও এখন বেশির ভাগ সুইমিং পুলই বন্ধ। তবুও বাড়িতে সাঁতারের ব্যবস্থা থাকলে দিনে আধ ঘণ্টা সাঁতার কাটতে পারেন।

 

দৌড়: করোনাকালে খোলা ছাদে মিনিট কুড়ি দৌড়ালেও ভাল কাজ হয়। অথবা খালি কোন মাঠ পেলে সেখানেও দৌড়াতে পারেন।

 

স্পট জগিং: বাড়ি থেকে বেরুনোর উপায় না থাকলে বাড়ির মধ্যে স্পট জগ করে নিতে পারেন।

 

খেলার মাধ্যমে: ব্যায়াম করতে ভাল না লাগলে টেনিস বা ব্যাডমিন্টনের মতো খেলা বেছে নিতে পারেন। এতেও কিন্তু ভালই ঘাম ঝরবে।

 

যোগব্যায়ামও উপকারী

ডায়াবেটিসের জন্য শরীরের স্ট্রেস হরমোনও সমান দায়ী। তাই হতাশা, ক্লান্তি কাটাতে মন শান্ত রাখা প্রয়োজন। ঘুম থেকে উঠে যোগব্যায়াম করতে পারেন। প্রাণায়াম, কপালভাতির মাধ্যমে অনেকটাই স্ট্রেস কেটে যায়। মেডিটেশন সূর্যপ্রণাম করলেও উপকার পাবেন।

 

ষাটোর্ধ্ব  হাঁটুর সমস্যায়

বয়সের কাটা পঞ্চাশের দিকে এগোলেই খাবারে রাশ টানা ব্যায়ামের রশি ধরার সময় শুরু। একটা বয়সের পরে হাঁটুর সমস্যা শুরু হয়। তার সঙ্গেই বয়সজনিত কারণে অনেকেরই গতিবিধি ক্রমশ শ্লথ হয়ে আসে। এই শারীরিক অক্ষমতার কারণে, হাঁটুর ব্যথার জন্য অনেকেই দৌড়নো, জগিং ইত্যাদি ভারী কার্ডিয়ো এক্সারসাইজ করতে পারেন না। তখন কিন্তু খাবার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে আর ভরসা রাখতে হবে ওষুধে। তবে হাঁটাচলা যোগব্যায়াম জারি রাখুন। মন শান্ত থাকলে স্ট্রেস হরমোন নিয়ন্ত্রিত থাকে।

 

চিকিৎসকদের মতে, কোনও ডায়াবেটিক রোগীর ইনসুলিন বা ওষুধ চলছে। ফলে রক্তে তার গ্লুকোজ লেভেল স্বাভাবিকের কাছাকাছিই রয়েছে। রোগী সেটা না বুঝতে খালি পেটে খুব ভারী ব্যায়াম করতে গেলেন। এতে কিন্তু ব্লাড সুগার লেভেল হুট করে অনেকটা নেমে গিয়ে রোগীর শরীরে ক্ষতি করতে পারে। তাই ইনসুলিন বা নিয়মিত ওষুধ চললে আরও সচেতন হতে হবে। ব্যায়ামের আগে অবশ্যই হালকা কিছু খেয়ে নিতে হবে। নিয়মিত ব্লাড সুগার পরীক্ষা করাও জরুরি।