দুই হাজার ১৫১ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের অভিযোগ এসআইবিএল এর সাত শাখায়

দুই হাজার ১৫১ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের অভিযোগ এসআইবিএল এর সাত শাখায়

শরিয়াহভিত্তিক স্যোসাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) সাত শাখায় দুই হাজার ১৫১ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

ব্যাংকটির সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ডা. মুহাম্মদ রেজাউল হকসহ বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এতে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ব্যাংকটির প্রিন্সিপাল শাখায় ৫৫০ কোটি, গুলশান শাখায় ৫৭৮ কোটি, বাবুবাজার শাখায় ২২৩ কোটি, খাতুনগঞ্জ শাখায় ১৬৫ কোটি, গাউছিয়া শাখায় ১৪০ কোটি, মাধবদী শাখায় ৫৫ কোটি ও আগ্রাবাদ শাখায় ৪৪০ কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদকের প্রধান কর্যালয় থেকে এ অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য কমিশন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর একজন উপপরিচালকের নেতৃত্বে দুই সদস‌্যের টিম গঠন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পরিচালক কাজী শফিকুল আলম (বিশেষ অনু: ও তদন্ত- ১) স্বাক্ষরিত চিঠির সূত্রে এ তথ‌্য জানা গেছে।

চিঠিতে দুদকের একজন উপপরিচালকের নেতৃত্বে দুই সদস্য বিশিষ্ট টিম গঠনপূর্বক অভিযোগসমূহ অনুসন্ধান করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। চিঠির সঙ্গে অভিযোগসহ ১৫ পৃষ্ঠার নথিপত্র সংযুক্ত করা হয়েছে।

এ বিষয়ে দুদক সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি অবগত নন বলে রাইজিংবিডিকে জানান।

তবে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা (উপপরিচালক) প্রনব কুমার ভট্টাচার্য‌্য এ বিষয়ে রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘মাত্র অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখনই বলার সময় আসেনি। তাছাড়া দুদকের আইন অনুযায়ী অনুসন্ধান চলার সময়ে এ বিষয়ে কোনো ধরণের বক্তব‌্য দেওয়ার সুযোগ নেই।’

অভিযোগের বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, স্যোসাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) প্রাক্তন চেয়ারম্যান ডা. মুহাম্মদ রেজাউল হক ব্যাংকের কয়েকটি শাখার মাধ্যমে ২ হাজার ১৫১ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। আর ওই টাকা আগামি নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেতে খরচ করেছেন।

এ ছাড়াও এরই মধ‌্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে ব্যাংকটির মাধ্যমে অর্থপাচার, নাশকতা ও সন্ত্রাসে অর্থায়নেরও বেশ কিছু অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে।

অভিযোগে আরো বলা হয়, ডা. রেজাউল হক ১৯৮৩ সালে সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে যান। এরপর ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এসআইবিএলের পরিচালক হন। বর্তমানে ব্যাংকটির সর্বমোট ৭৩ কোটি ৮২ লাখ ৯৮ হাজার ৬৪২টি শেয়ারের মধ্যে ২ শতাংশ বা ১ কোটি ৪৭ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৮টি শেয়ারের মালিক রেজাউল হক। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে চতুর্থবারের মতো তিন বছরের জন্য চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ২০১২ সালে তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির পরিবারকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। আগামি নির্বাচনে নোয়াখালী-৩ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী তিনি। এর আগে তিনি ফ্রিডম পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

অভিযোগ রয়েছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য পেট্রোল বোমার অর্থের অন্যতম জোগানদাতা রেজাউল হক। চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে ব্যাংকের ব্যাপক অর্থ তছরুপ করে একটি চক্রের মাধমে আত্মসাৎ ও বিএনপি-জামায়াত চক্রের সমর্থনে ব্যয় করছেন তিনি। ব্যাংকের শীর্ষ ব্যক্তির অর্থ আত্মসাৎ ও জালিয়াতির ফলে গ্রাহকদের হাজার হাজার কোটি টাকা ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

সূত্র আরো জানায়, তিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে ২০১৫ সালে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকায় গাড়ি ক্রয় করেন। চলতি বছরের এপ্রিলে সাড়ে ৩ কোটি টাকায় আরেকটি গাড়ি কেনেন। যদিও ১ কোটি টাকার বেশি মূল্যের গাড়ি কেনার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধিনিষেধ রয়েছে। অবৈধ আর্থিক সুবিধার বিষয়ে যেন কেউ প্রতিবাদ না করতে পারেন এ জন্য তিনি বেশ কয়েকজন পরিচালককেও অবৈধভাবে টাকা খরচের অনুমোদন দিয়েছেন। বাংকে কর্মী নিয়োগেও বাণিজ্য করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এসআইবিএল ফাউন্ডেশন হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনার নামে ৮০ কোটি টাকা মুনাফাবিহীন ঋণ দিয়েছেন তিনি। ওই হাসপাতালের এমডি রেজাউল হকের স্ত্রী। আমানতকারীদের টাকা এভাবে কোথাও ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই। ২০১৬ সালের ৮০ হাজার বার্ষিক রিপোর্ট ছাপানোর জন্য প্রতি পিস ৩৫৫ টাকা হিসেবে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। অথচ মাত্র ৫ হাজার পিস রিপোর্ট ছাপানো হয়েছে বলে জানা গেছে। বড় অঙ্কের ঋণগুলো তার ব্যক্তিগত ইচ্ছায় দেওয়া হয়। ঋণের টাকা পাচারও হয়েছে বলে জানা গেছে। ব্যাংকের টাকায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অফিসের খরচ চালান বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বেশ কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে।

সূত্র জানায়, বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণে বাংলাদেশ ব্যাংক নিরুৎসাহিত করলেও এক বছরে বড় ঋণ বিতরণ দ্বিগুণ বাড়িয়েছে এসআইবিএল। ২০১৫ সালে ব্যাংকটির বড় অঙ্কের ঋণগ্রহীতা ছিলেন ১০ জন। তারা ২ হাজার ৩৩ কোটি টাকা নেন। এক বছরে বড় গ্রাহক বেড়ে হয়েছে ২০ জন। তারা নিয়েছেন ৪ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি গ্রাহকদেরকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। ইস্কাটন শাখার এক গ্রাহককে দেওয়া ২০০ কোটি টাকা অন্য খাতে ব্যবহার করা হয়েছে। ভুয়া এলসি দেখিয়ে বাবুবাজার শাখার এক গ্রাহককে দেওয়া হয়েছে ৪০ কোটি টাকার ঋণ। আগ্রাবাদ শাখা থেকে আমদানি-রপ্তানির নামে ২৪০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন এক গ্রাহক। ঋণের অধিকাংশ টাকা পাচার করা হয়েছে। খাতুনগঞ্জ শাখার এক গ্রাহককে মালামাল সরবারহের জন্য দেওয়া হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। ওই গ্রাহক কর্মচারীদের নামেও অ্যাকাউন্ট খুলে ঋণ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে অনুষ্ঠিত ব্যাংকটির বোর্ড সভায় ব্যাংকের টাকা তছরুপের অভিযোগের মুখে পদত্যাগ করেন এসআইবিএল-এর চেয়ারম্যান মেজর (অব.) ডা. রেজাউল হক ও এমডি শহীদ হোসেন ও একজন পরিচালক। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ১৪ নভেম্বর পদত‌্যাগ করেন আরো সাত জন পরিচালক।