বিস্ময়কর শিশু

বিস্ময়কর শিশু

শৈশব বলতে আমরা খেলাধুলা, বড্ড খামখেয়ালিপূর্ণ দুষ্টামিতে ভরা জীবনকে বুঝি। যেখানে থাকে আদর আর যত্ন নামক শব্দগুলো। শৈশব শব্দটা তো এই দুরন্তপনা ঘটনাগুলোর সঙ্গেই যাওয়ার কথা। কিন্তু এই তালিকার বাইরেও কিছু খুদে প্রাণ আছে, যারা মুখোমুখি হতে ভালোবাসে প্রতীক। হয়তো তাদের দেখতে অনীহা জাগতে পারে কিন্তু তাদের সম্পর্কে আপনি জানলে, আপনার কৌতূহল আরও বাড়বে। অস্বাভাবিকভাবে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা প্রাণগুলো নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন। জানাচ্ছেন— হাবিবুর রহমান অনিক

বিস্ময়কর শিশু

বেন আন্ডারউড

[ম্যান অব ইকোলোকেশন]

শব্দের প্রতিধ্বনির মাধ্যমে কোনো কিছু শনাক্ত করাই ‘ইকোলোকেশন’। আরেকটু সহজ করে বলতে গেলে নাক এবং মুখের মাধ্যমে শব্দ তরঙ্গ তৈরি করে ও শব্দের প্রতিধ্বনি অনুসরণ করে খুঁজে নেওয়া হয়  কাঙ্ক্ষিত পথ বা বস্তু। আঁধার রাতে বাদুড় এই পদ্ধতিতে চলাফেরা করে। দৃষ্টিহীন বেন আন্ডারউডের গল্পটিও একই রকম। ‘ইকোস অব এন এঞ্জেল’ বইয়ের মূল চরিত্র তাকে ঘিরেই। মাত্র ৩ বছর বয়সে রেটিনাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বেন তার চোখ দুটি হারায়। ফলত চিরতরে অন্ধ হয়ে যায় বেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় পরিবারের সঙ্গে তার বেড়ে ওঠা। অন্ধ হওয়া স্বত্ত্বেও বেনকে দেখে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। প্রায় সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছিল। বেন ধীরে ধীরে শব্দ তৈরি করে তার প্রতিধ্বনি ব্যবহার করে চলাচল করতে শেখে। শুধু তাই নয়, বেন বড় হয়ে বাস্কেটবল, স্কেটবোর্ড এবং সাইকেল চালাতে পারত। একই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৯ সালে বেন মারা যায়।

 

শিলো পেপিন

[সত্যিকারের মত্স্যকন্যা]

শিলো পেপিন। জন্ম থেকেই অন্য সবার চেয়ে আলাদা। পেপিনকে সবাই মত্স্যকন্যা বলেই চেনে। ১৯৯৯ সালে ‘মারমেইড সিন্ড্রোম’ নামের এক জটিল সমস্যা নিয়ে পৃথিবীতে আসে পেপিন। জন্ম থেকেই তার দুই পা জোড়া লাগানো। ‘সিরনোমেইলিয়া’ নামক বিরল রোগে আক্রান্ত ছিল পেপিন। তার প্রধান ধমনী সরাসরি তার পায়ের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করত না। ফলত পেপিনের কোনো মূত্রাশয় ছিল না। শুধু তাই নয়, পেপিনের কিডনি খুব সামান্যই কাজ করত। এমতাবস্থায় ডাক্তাররা ভেবেছিলেন জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই সে মারা যাবে। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করে পেপিন ২০০৯ সালে তার দশম জন্মদিন পালন করেছিল। তবে এটাই ছিল পেপিনের শেষ জন্মদিন। জীবনের বিরুদ্ধে লড়াই করে মাত্র ১০ বছর বয়সে কেনিবাঙ্কপোর্টে মারা যায়। অবুঝ শিশুটি স্কুলে পড়াশোনা করত এবং ‘দ্য অপরাহ উইনফ্রেই’সহ বিভিন্ন চ্যানেলের টক-শো’তে অংশ নিয়েছিল।

 

বায়োজিদ হোসেন

[দ্য বেঞ্জামিন বাটন]

চেহারায় শিশুর কোনো ছাপ নেই। অদ্ভুত এক রোগ নিয়ে ২০১২ সালে জন্ম নেয় বায়োজিদ। জন্ম থেকেই বায়োজিদ ‘প্রোজেরিয়া’ নামক রোগে আক্রান্ত। রোগটার পরিচয় দিতে গেলে বলতে হয়, এটি মানুষের মানসিক বার্ধক্যের আগেই ডেকে আনে শারীরিক বার্ধক্য। ফলশ্রুতিতে পাঁচ বছরের বায়োজিদের দেহে বাস করছিল সত্তর বছর বয়সী বুড়ো। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারায় বৃদ্ধ মানুষের ছাপ আরও বেশি ফুটে উঠছিল এবং তার মুখ ও পেটসহ শরীরের চামড়া ঝুলে যায়। তাকে দেখলেই অন্য শিশুদের মনে ভয়ের সঞ্চার হতো। ফলে সে অন্য সবার মতো স্কুলে যেতে পারত না। তবে তার বুদ্ধিমত্তা শিক্ষক ও অভিভাবকদের মুগ্ধ করেছিল। গণমাধ্যমগুলো তাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর মাগুরার সিভিল সার্জন মেডিকেল বোর্ড গঠন করে এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হলে সে কিছুটা সুস্থ হয়। তবে, বিরল প্রোজেরিয়া আক্রান্ত রোগী ১৩ বছরের বেশি সময় বাঁচে না। শেষমেশ শঙ্কা সত্যি হলো, গেল বছর ডিসেম্বরে বায়োজিদ মৃত্যুবরণ করে।

 

শিন হুমইউং

[কোরিয়ান পিটার প্যান]

রূপকথার চরিত্রই দেখা গেল বাস্তবে। দক্ষিণ কোরিয়ার পিটার প্যান খ্যাত যুবক শিন হুমইউং। কিন্তু শিনের বয়স বাড়লেও বাচ্চামি চেহারাটাই রয়ে গেল। ১৯৮৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার স্পেকট্রামের জন্ম নেয় এই বেবি চেহারার শিন। সে মূলত ‘হাইল্যান্ডার সিন্ড্রোম’ নামের বিরল রোগে আক্রান্ত। দেখতে নাদুসনুদুস বাবু হলেও বোঝার উপায় নেই যে, সে বর্তমানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক। দক্ষিণ কোরিয়ায় সম্প্রচারিত এক ডকুমেন্টারিতে দেখা যায় শিনের বার্ধক্য অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। ডাক্তারদের মতে, শারীরিকভাবে শিন সুস্থ। তবে সে এখনো স্বাভাবিক জীবনে সম্পূর্ণভাবে ফিরতে পারেনি। ২৬ বছর বয়সী শিন স্থানীয় বারে বন্ধুদের সঙ্গে নেচে-গেয়ে জীবন উপভোগ করার পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছে ফটোগ্রাফি। স্থানীয়রা আজও তাকে তাদের পিটার প্যান বলে ডাকেন।

 

শার্লট গারসিডি

[সবচেয়ে ছোট শিশু]

শার্লট গারসিডি যখন জন্মগ্রহণ করে তখন তার ওজন ছিল মাত্র ৫০০ গ্রাম ও দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ২৫ সেন্টিমিটার (১০ ইঞ্চি)। এ সময় তাকে রোগা দেখাচ্ছিল এবং শরীরের চামড়া ছিল খরগোসের মতো। ‘টিনিয়েস্ট গার্ল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ শিরোনামে ডেইলি মেইলের করা প্রতিবেদনে এমনটাই বলেন শার্লটের মা এমা নিউম্যান। স্কট গারসিডি এবং এমা নিউম্যানের ঘরে আর দুটি সন্তান রয়েছে, যারা প্রত্যেকেই স্বাভাবিক। বাবা-মা ভাবেননি শার্লটের প্রথম জন্মদিন পালন করতে পারবেন। কেননা, ডাক্তারদের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল ভয়ে ভরা। কিন্তু বর্তমানে শার্লটের বয়স ৬ বছর চলছে এবং সে বাবা-মায়ের আদরে বড় ও স্কুলে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত, মানসিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল হওয়ার কারণে অন্য শিশুদের চেয়ে সে পিছিয়ে আছে। শার্লট এখন ৭০ সেন্টিমিটার (২.৪ ফুট) উচ্চতার ও নবজাতকের জন্য তৈরি পোশাক তার পরনে ফিট হয়ে যায়।

 

জিয়ানহাং

[চীনের মৎস্যবালক]

চীন দেশে ‘মত্স্যবালক’ নামেই জিয়ানহাং বেশ পরিচিত। বিরল এক রোগ নিয়ে জিয়ানহাং জন্মগ্রহণ করে। তার শরীরের চামড়া মাছের মতো পেঁচিয়ে থাকে। বিজ্ঞানের ভাষায় রোগটিকে ‘ইনহেরিটেড স্কিন ডিজিজ’ বলা হয়ে থাকে। এটি এমন এক বিরল রোগ যা সীমিত গতিশীলতার কারণে রোগীর জীবনমানের সীমাবদ্ধতা ডেকে আনে। পূর্ব চীনের উপকূলীয় প্রদেশ ওয়েনিলিংয়ে জিয়ানহাংয়ের জন্ম। তার পুরো নাম প্যান জিয়ানহাং। অদ্ভুত এই মত্স্যবালক যখন জন্ম নেয় তখন তার শরীর স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চামড়ার পুরুত্ব বাড়তে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাত্র আট বছর বয়সী জিয়ানহাং বিরল রোগটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে কিন্তু প্রতি বছর এই একই সমস্যা নিয়ে প্রায় ১৬ হাজারের মতো শিশু জন্ম নেয়। এটি এমনই একটি চর্মরোগ যা জিনের মাধ্যমে আসে। তার এই সমস্যা হতে উত্তরণে ডাক্তারদের বেপরোয়া প্রচেষ্টা থাকলেও মেলেনি কোনো সুফল। তবে ঠাণ্ডা পানি ও ডাক্তারদের দেওয়া মলমজাতীয় ওষুধ তাকে কিছুটা স্বস্তি দেয়।

 

তিসা ইভান্স

[নাকহীন মানবী]

ছোট্ট তিসা ইভান্স। বিরল এক রোগ নিয়ে আরিয়ানা অঙ্গরাজ্যে জন্মগ্রহণ করে। যার ফলে তিসার ছিল না কোনো নাসারন্ধ্র বা কোনো নাসাগহ্বর। ফলশ্রুতিতে তার শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য নাক ছিল না এবং সে গন্ধ শনাক্ত করতে পারত না। কিন্তু জন্মের পর তার ঠাণ্ডা বা সর্দির মতো উপসর্গ লেগেই থাকত। জন্মের পর তাকে শ্বাস নেওয়ার জন্য ট্রাকিওস্টোমি টিউবের সাহায্য নিতে হয়েছিল। পাশাপাশি কয়েক মাস মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে হয়। ডাক্তার বলেন, দীর্ঘমেয়াদি বিপদ এড়াতে প্রাথমিক পর্যায়ে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তিসার বাব-মা তার স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা নিয়ে উদ্ব্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। শ্বাস-প্রশ্বাস এবং গন্ধ শনাক্তকরণে অন্য ইন্দ্রিয়ের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে বলে তখন চিকিৎসকরা জানান। একপর্যায়ে বাবা-মা নতুন এই পদ্ধতির চিকিৎসার প্রথম রোগী হিসেবে নিজের সন্তান তিসাকে দিতে রাজি হন। এই চিকিৎসায় অত্যাধুনিক মেশিনের মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে নাকে চামড়া বসিয়ে নাক সার্জারি করা হয়। তিসার প্রাথমিক অস্ত্রোপচার সফল হয় এবং কৃত্রিম নাকটি দেখতে অবিকল সুস্থ প্রাপ্তবয়স্কের মতো দেখায়।

 

ক্রিশ্চিনা পিমেনোভা

[পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী শিশু]

বয়স তখনো তিন পেরোয়নি। বাবা-মা শখ করে নাম জুড়ে দেন মডেলিংয়ের প্রতিযোগিতায় এবং নয় বছর বয়সেই বিশ্বের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সুন্দরী মেয়ের আখ্যা পায়। নাম ক্রিশ্চিনা পিমেনোভা। ২০০৫ সালে রাশিয়ার মস্কো শহরে জন্ম নেওয়া ক্রিশ্চিনা মডেলিং দিয়েই জীবন শুরু করে। সেই ছোট্ট থেকে বিজ্ঞাপনে কাজ করে আসছে ছোট্ট এই সুন্দরী। ইতিমধ্যে ‘ডলস অ্যান্ড গাব্বানা’ এবং ‘রবার্ট কাভালি’র মতো অভিজাত ব্র্যান্ডগুলোয় সে কাজ করেছে। মডেলদের যে বয়সে হাতেখড়ি শুরু হয়, সেই বয়সে অর্থাৎ বর্তমানে মাত্র ১২ বছর বয়সে ক্রিশ্চিনা প্রাপ্তবয়স্কদের মতো অভিনয় করাও শুরু করে দিয়েছে। তার ফেসবুক পেইজেও আছে দুই মিলিয়নেরও অধিক লাইক এবং সেই পেইজটা মা গ্লিকেরিয়া শিরোকোভা পরিচালনা করেন। মায়ের হাত ধরেই ক্রিশ্চিনার মডেলিংয়ের পদচারণা শুরু এবং যেতে চায় বহুদূর।