আমেরিকার গ্রিনকার্ড পাওয়া যাবে যেভাবে

আমেরিকার গ্রিনকার্ড পাওয়া যাবে যেভাবে

ছোট চারকোনা যে প্লাস্টিক কার্ডটিকে আমরা গ্রিনকার্ড নামে ডাকি তার একটা গালভরা নাম আছে। সেটি হচ্ছে ‘ফরম আই-৫৫১’ বা স্থায়ী আবাসন কার্ড। স্বপ্নের এই গ্রিনকার্ড হলো ন্যাচারালাইজেশনের মাধ্যমে আমেরিকার নাগরিক হওয়ার প্রথম ধাপ। বেশ কয়েকটি উপায়ে এই গ্রিনকার্ড পাওয়া যেতে পারে—যেমন পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে, চাকরির মাধ্যমে, বিনিয়োগের মাধ্যমে, শরণার্থী অথবা আশ্রয় প্রার্থনার মাধ্যমে। এ ছাড়া আরও কিছু মাধ্যম রয়েছে। শুধু পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমেই আটটি ভিন্ন ক্যাটাগরিতে গ্রিনকার্ড পাওয়া যায়।

 

সেগুলো হচ্ছে—

১. মার্কিন নাগরিকের স্বামী বা স্ত্রী কিংবা ২১ বছরের কম বয়সী অবিবাহিত সন্তান অথবা এর বেশি বয়সী মার্কিন নাগরিকের মা-বাবা হলে ওই মার্কিন নাগরিকের নিকটাত্মীয় (ইমিডিয়েট রিলেটিভ) হিসেবে আপনি গ্রিনকার্ড পেতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবেই ভিসা নম্বর পাওয়া যায়।

 

২. মার্কিন নাগরিকের ২১ বছরের চেয়ে বেশি বয়সী অবিবাহিত সন্তান কিংবা যেকোনো বয়সী বিবাহিত সন্তান এবং ২১ বছরের বেশি বয়সী মার্কিন নাগরিকের ভাই-বোন হলেও আপনি গ্রিনকার্ড পেতে পারেন। তবে তা মার্কিন নাগরিকের নিকটাত্মীয় হিসেবে নয়। এ ক্ষেত্রে প্রতি বছর নির্দিষ্ট সংখ্যক অভিবাসীকে সুযোগ দেওয়া হয়। তাই ভিসা নম্বর পেতে অপেক্ষা করতে হয়।

 

৩. আপনি যদি বৈধ স্থায়ী অভিবাসী বা গ্রিনকার্ডধারীর স্বামী-স্ত্রী অথবা ২১ বছরের কম বয়সী অবিবাহিত সন্তান বা এর বেশি বয়সী অবিবাহিত সন্তান হন, তবে গ্রিনকার্ডধারীর পারিবারিক সদস্য হিসেবে আপনিও গ্রিনকার্ড পেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে যেহেতু প্রতি বছর নির্দিষ্ট সংখ্যক অভিবাসীকে সুযোগ দেওয়া হয়, তাই ভিসা নম্বর পেতে অপেক্ষা করতে হয়।

 

এই লেখায় আমরা এই আট ধরনের গ্রিনকার্ডের মধ্যে মার্কিন নাগরিকের আমেরিকার বাইরে অবস্থানরত স্বামী/স্ত্রীর গ্রিনকার্ড নিয়ে আলোচনা করব। আপনি যদি মার্কিন নাগরিক হন এবং আপনার স্বামী/স্ত্রী যদি আমেরিকার বাইরে থাকে তবে গ্রিনকার্ডের জন্য— (ক) আপনাকে ফরম আই-১৩০, পিটিশন ফর এলিয়েন রিলেটিভ (ii) স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ফরম আই-১৩০এ জীবন বৃত্তান্ত (iii) ইউএসডিএইচএস বরাবর ৫৩৫ ডলারের চেক বা মানি অর্ডার (iv) বিয়ের সনদের অনুলিপি ও আপনাদের মধ্যে কারও পূর্ব-বিবাহ থাকলে, তার বিচ্ছেদ কিংবা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে মৃত্যুর সনদ (v) সাদা পশ্চাৎপটে উভয়ের দুই কপি করে পাসপোর্ট সাইজ ছবি (vi) মার্কিন নাগরিকত্বের প্রমাণস্বরূপ ন্যাচারালাইজেশন সনদ/নাগরিকত্ব সনদ/ জন্ম সনদ/মেয়াদোত্তীর্ণ নয় এমন ইউএস পাসপোর্টের অনুলিপি এবং এর সঙ্গে বাড়তি প্রমাণ হিসেবে (vii) যৌথ সম্পত্তি/ব্যাংক হিসাবের নথি (viii) সন্তান থাকলে তার জন্ম সনদ ও (ix) বিয়ের উদ্দেশ্য ও বর্তমান অবস্থা জানেন এমন একজন বা দুজন ব্যক্তি কর্তৃক প্রয়োজনীয় সব তথ্যসহ অ্যাফিডেভিট জমা দিতে হবে। ফরম আই-১৩০ ও ফরম আই-১৩০-এ পূরণ করতে ওপরে উল্লেখিত কাগজপত্রের বাইরে উভয়ের মা-বাবার জন্ম তারিখ ও জন্মস্থান, পাঁচ বছরের ঠিকানা ও বসবাসের তারিখ এবং আবেদনকারীর সামাজিক নিরাপত্তা নম্বর প্রয়োজন হবে।

 

(খ) আপনার আবেদন জমা পড়ার পর প্রথমে প্রাপ্তি স্বীকার ও পরে অনুমোদন আপনাকে আই-৭৯৭সি, নোটিশ অব অ্যাকশনের মাধ্যমে জানানো হবে। পরবর্তী প্রক্রিয়ার জন্য আপনার স্বামী বা স্ত্রীর দেশের কনস্যুলেট অফিসে পাঠানো হবে। এই নোটিশ প্রাপ্তির পর এক বছরের মধ্যে পরবর্তী কার্যক্রম নিম্নোক্ত ছয়টি ধাপে সম্পন্ন করার নির্দেশনা দিয়ে এনভিসি কেস নম্বর এবং ইনভয়েস আইডি নম্বর উল্লেখ করে আরেকটি চিঠি পাঠানো হবে।

 

I. এজেন্ট নিয়োগ: ‘ফরম ডিএস-২৬১, চয়েস অব অ্যাড্রেস অ্যান্ড এজেন্ট’ পূরণ করে কনস্যুলার ইলেকট্রনিক অ্যাপ্লিকেশন সেন্টারে জমা দিয়ে আবেদনকারী নিজেই তার স্বামী বা স্ত্রীর এজেন্ট হতে পারেন যেন ন্যাশনাল ভিসা সেন্টার থেকে যাবতীয় যোগাযোগ তার সঙ্গেই করা হয়।

II. আপনাকে যেকোনো আমেরিকান ব্যাংকের চেকিং অ্যাকাউন্ট নম্বর ও রাউটিং নম্বর উল্লেখ করে ইমিগ্রেশন ভিসা ইনভয়েস পেমেন্ট সেন্টারে দুটো প্রসেসিং ফি দিতে হবে। ইমিগ্রেশন ভিসা অ্যাপ্লিকেশন প্রসেসিং ফি ১২০ ডলার। অ্যাফিডেভিট অব সাপোর্ট ফি ৩২৫ ডলার

 

III. ফি পরিশোধের পর ‘ফরম ডিএস-২৬০, অ্যাপ্লিকেশন ফর ইমিগ্রান্ট ভিসা অ্যান্ড এলিয়েন রেজিস্ট্রেশন’ পূরণ করে কনস্যুলার ইলেকট্রনিক অ্যাপ্লিকেশন সেন্টারে জমা দিতে হবে। এই ফরম পূরণের সময় ওপরে উল্লেখিত কাগজপত্রের বাইরে পাসপোর্টের বিস্তারিত তথ্য, বাবা-মা মৃত হলে মৃত্যুর সাল, আবেদনকারীর স্বামী বা স্ত্রীর মাধ্যমিক পরবর্তী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার বিস্তারিত তথ্য প্রয়োজন হবে।

 

IV. এই পর্যায়ে আপনাকে আর্থিক কাগজপত্র সংগ্রহ করতে হবে। ‘ফরম আই-৮৬৪পি, ২০১৭ এইচএইচএস পভার্টি গাইডলাইন ফর অ্যাফিডেভিট অব সাপোর্ট’-এ উল্লেখিত হাউজহোল্ড সাইজ অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের বেশি বার্ষিক গড় আয়ের সর্বশেষ বছরে আয়কর দাখিল করেছেন এমন যেকোনো একজন ব্যক্তি—আবেদনকারী নিজে বা অন্য যে কেউ ‘ফরম আই-৮৬৪, অ্যাফিডেভিট অব সাপোর্ট’ পূরণ করবেন। মূলত এই কাজটিকেই বলা হয় স্পনসর করা। যিনি স্পনসর করবেন তার সর্বশেষ তিন বছরের আইআরএস ট্রান্সক্রিপ্ট, তিন বছরের ফরম উব্লিউ-২ বা ফরম ১০৯৯-সহ আয়কর দাখিলের সব কপি, জব লেটার অথবা সমসাময়িক ছয় মাসের পে স্টাব, রিলেশনশিপ লেটার, নাগরিকত্ব সনদ/জন্ম সনদ/আনএক্সপায়ার্ড ইউএস পাসপোর্ট/গ্রিনকার্ডের কপি এই ফরমের সঙ্গে জমা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, স্পনসর যদি আবেদনকারী ব্যতীত অন্য কেউ হন এবং তার স্বামী-স্ত্রী বা অন্য কোন হাউজহোল্ড মেম্বারের আয়সহ জয়েন্ট ট্যাক্স ফাইল করে থাকেন তবে সেই স্বামী-স্ত্রী বা হাউজহোল্ড মেম্বারের মাধ্যমে ‘ফরম আই-৮৬৪এ, কন্ট্রাক্ট বিটুইন স্পনসর অ্যান্ড হাউজহোল্ড মেম্বার’ পূরণ করতে হবে। এই ফরম আই-৮৬৪ এবং ফরম আই-৮৬৪এ পূরণের সময় ওপরে উল্লেখিত কাগজপত্রের বাইরে স্পনসর ও তাঁর স্বামী/স্ত্রীর জন্মস্থান, এখনো গ্রিনকার্ডধারী রয়েছেন এমন কয়জনকে আগে স্পনসর করেছেন সেই সংখ্যা, সব সেভিংস ও চেকিং অ্যাকাউন্টের ব্যালান্স, কোন রিয়েল এস্টেট প্রোপার্টি থাকলে মর্টগেজ ঋণ বাদ দিয়ে ওই প্রোপার্টির নেট ভ্যালু ও ওই প্রোপার্টির লোকেশন, মালিকানা ও অ্যাকুইজিশনের কাগজ, ফোন নম্বর ও ই-মেইল অ্যাড্রেস প্রয়োজন হবে।

V. এই পর্যায়ে আপনাকে সিভিল ডকুমেন্টস সংগ্রহ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে দুজনের জন্ম সনদ, বিয়ের কাবিন এবং কারও যদি কোন পূর্ব বিবাহ থাকে তাহলে বিবাহ বিচ্ছেদ বা মৃত্যু সনদ, স্বামী বা স্ত্রীর পাসপোর্টের বায়োগ্রাফিক ডেটা পেজের কপি এবং এক বছরের কম পুরোনো পুলিশ সনদের কপি।

VI. সবশেষে সংগ্রহ করা সব আর্থিক প্রমাণপত্র ও সিভিল ডকুমেন্টস নিউ হ্যাম্পশায়ারে অবস্থিত ন্যাশনাল ভিসা সেন্টারে পাঠাতে হবে।

 

(গ) ভিসা ইন্টারভিউয়ের ধার্যকৃত দিনের এক মাস আগে আপনাকে এবং যার জন্য আবেদন করেছেন আপনার স্বামী বা স্ত্রী তাকে জানানো হবে। ন্যাশনাল ভিসা সেন্টার থেকে সব কাগজপত্র কনস্যুলেট অফিসে পাঠানো হবে। ইন্টারভিউয়ের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে দুটো কাজ করতে হবে।

(১) আগে ফটোকপি জমা দেওয়া হয়েছে এমন সব কাগজপত্রের মূল কপি ইন্টারভিউয়ে সঙ্গে নেওয়ার জন্য সংগ্রহ করতে হবে;

(২) ইন্টারভিউয়ের কমপক্ষে দুই সপ্তাহ আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য অনুমোদিত চিকিৎসকের কাছ থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে। চিকিৎসকের পরীক্ষার সময় আবেদনকারীকে সঙ্গে তার পাসপোর্ট ও চার কপি ছবি নিতে হব। ১৫ বছরের বেশি বয়সী আবেদনকারীর জন্য ৩ হাজার ৪৫০ টাকা ফি দিতে হবে।

 

(ঘ) অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার, পাসপোর্ট, দুই কপি রঙিন ছবি, স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদন, সব কাগজপত্রের মূল কপিসহ নির্ধারিত দিনে ইন্টারভিউ দিতে কনস্যুলেট অফিসে হাজির হতে হবে। ইন্টারভিউ শেষে ভিসা অফিসার তার ভিসা দেওয়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন। এরপর আপনাকে অনলাইনে একটি প্রোফাইল তৈরি করতে হবে। প্রোফাইল তৈরির সময় যে পিকআপ লোকেশন পছন্দ করা হয়েছে সেখান থেকে পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র সংগ্রহ করতে হবে। ভিসা স্টিকার পাসপোর্টে লাগিয়ে দেওয়া ছাড়াও একটি ইমিগ্রেশন প্যাকেট দেওয়া হবে যা মুখ বন্ধ অবস্থায় আমেরিকার বিমান বন্দরে ইমিগ্রেশনের সময় জমা দিতে হবে। ভিসা দেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে আমেরিকায় ঢুকতে হবে। এরপর গ্রিনকার্ড বা ইউএসসিআইএস ইমিগ্রান্ট বাবদ ২২০ ইউএস ডলার ফি জমা দিতে হবে।

 

এই ফি পরিশোধ করা না হলে গ্রিনকার্ড দেওয়া হবে না। গ্রিনকার্ড ইস্যু করার দিন যদি বিয়ের বয়স দুই বছরের কম হয় তবে পরবর্তী দুই বছরের জন্য কন্ডিশনাল গ্রিনকার্ড দেওয়া হবে। সেই কন্ডিশন রিমুভ করার জন্য গ্রিনকার্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগে ৫৯০ ডলার ফিসহ ‘ফরম আই-৭৫১, পারমিট টু রিমুভ দ্য কন্ডিশন্‌স অব রেসিডেন্স’ পূরণ করে জমা দিতে হবে। এর সঙ্গে সন্তান থাকলে সন্তানের জন্ম সনদ, বাড়ি ভাড়ার চুক্তি যেখানে স্বামী-স্ত্রী দুজনের নাম রয়েছে, যৌথ সেভিংস ও চেকিং অ্যাকাউন্ট, যৌথ আয়কর দাখিল, যৌথ গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ বিল এবং কন্ডিশনাল গ্রিনকার্ড পাওয়ার সময় থেকে বৈবাহিক সম্পর্কের বিষয়ে আবগত আছেন এমন দুজন ব্যক্তির অ্যাফিডেভিট জমা দিতে হবে।