কপাল খুলছে ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষকদের

কপাল খুলছে ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষকদের

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষকদের কপাল খুলছে। এসব মাদ্রাসার শিক্ষকরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো সমান মর্যাদা পাচ্ছেন। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা পরিচালনাসংক্রান্ত খসড়া নীতিমালায় এ প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে নীতিমালা অনুযায়ী নতুন মাদ্রাসা স্থাপন, শিক্ষক নিয়োগ ও মাদ্রাসা পরিচালনা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের তৈরি করা খসড়া নীতিমালা পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে। 

 

বিষয়টি স্বীকার করে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাদ্রাসা) ও নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক রওনক মাহমুদ আজকালের খবরকে বলেন, ‘নীতিমালাটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে খসড়ায় স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষকদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমান মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।’ 

 

তিনি আরও বলেন,‘ শিক্ষক নিয়োগ, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, মাদ্রাসা পরিচালনাসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় নীতিমালায় প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার  বৈঠক করে নীতিমালাটি চূড়ান্ত করা হবে।’

 

খসড়া নীতিমালায় ১৯টি দফা রয়েছে। দফাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মহানগর, পৌর ও শহর এলাকার মাদ্রাসায় কমপক্ষে ২০০ এবং মফস্বল এলাকা ১৫০ জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। প্রতিটি মাদ্রাসায় একজন প্রধান শিক্ষক, চারজন সহকারী শিক্ষক ও একজন অফিস সহায়ক থাকবেন। প্রধান শিক্ষকের শিক্ষগত যোগ্যতা হবে ফাজিল (ডিগ্রি পাস) আর সহকারী শিক্ষকদের এইচএসসি পাস। চারজন সহকারী শিক্ষকের মধ্যে একজন কারি নিয়োগ দিতে হবে। তার শিক্ষকতা যোগ্যতা হবে আলিম পাস। অফিস সহায়কের এসএসসি পাস হতে হবে। শিক্ষাজীবনে তৃতীয় বিভাগ গ্রহণযোগ্য হবে না। 

 

মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অনুমোদিত সিলেবাস ও পাঠ্যপুস্তক পাঠদান করতে হবে। সহশিক্ষা হিসেবে কেরাত, হামদ, নাত প্রতিযোগিতা, বার্ষিক ক্রীড়া, খেলাধুলা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা, বৃক্ষরোপণ, কাব দল (স্কাউটিং), পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম করতে হবে। 

 

নীতিমালা অনুযায়ী পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি শিক্ষক নিয়োগ দিবে। এই কমিটির সভাপতি হবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আর মেট্রোপলিটন এলাকায় জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। সদস্য সচিব হবেন সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক। কমিটির অপর সদস্যরা হবেন-উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা বা থানা সদরের এমপিওভুক্ত একটি ইবতেদায়ী মাদ্রাসার প্রধানের প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসার সভাপতি। 

 

মাদ্রাসাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি উপজেলা ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক কমিটি গঠিত হবে। এই কমিটির সভাপতি হবেন ইউএনও আর মেট্রোপলিটন এলাকায় জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, সদস্য সচিব হবেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। কমিটির অপর সদস্যরা হবেন-উপজেলা বা থানা সদরের এমপিওভুক্ত একটি ইবতেদায়ী মাদ্রাসার প্রধান, স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের একজন প্রতিনিধি। 

 

নতুন মাদ্রাসা স্থাপনের ক্ষেত্রে নীতিমালায় বলা হয়েছে- একটি মাদ্রাসা হতে অপর মাদ্রাসার দূরত্ব শহর এলাকায় এক কিলোমিটার। মফস্বল এলাকায় দুই কিলোমিটার। প্রাথমিক স্কুলের মতো মফস্বল এলাকার মাদ্রাসার শূন্য দশমিক ৩৩ একর, পৌর এলাকায় শূন্য দশমিক ২০ একর ও মেট্রোপলিটন এলাকায় শূন্য দশমিক ১০ একর জমি থাকতে হবে। মাদ্রাসার নামে রেজিস্ট্রি করা জমিতে অন্তত টিনের বেড়াসহ টিনশেড ভবন বা পাকাভবন থাকতে হবে। শিক্ষার্থী প্রতি এক বর্গমিটার হিসাবে শ্রেণিকক্ষের আয়তন থাকতে হবে। প্রধান শিক্ষকের অফিস, শিক্ষক মিলনায়তনসহ অন্তত পাঁচটি কক্ষ থাকতে হবে। মানসম্মত টয়লেট, শৌচাগার, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকলে পর্যায়ক্রমে সংযোগ নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য খেলার মাঠ ও পাঠাগার থাকতে হবে।

 

নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে- মাদ্রাসার স্থায়ী আমানত হিসেবে ব্যাংকে ২০ হাজার টাকা থাকতে হবে। নতুন মাদ্রাসা স্থাপনের ক্ষেত্রে ‘মহান’ ব্যক্তির নামে নামকরণ করতে হলে সরকারি তহবিলে কোনো অর্থ জমা দিতে হবে না। তবে কোনো ব্যক্তির নামে করতে হলে মাদ্রাসার তহবিলে পাঁচ লাখ টাকা জমা রাখতে হবে। 

 

নতুন মাদ্রাসা স্থাপনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সরেজিমন পরিদর্শন প্রতিবেদনের আলোকে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড অনুমোদন দিবে। অনুমোদনের পরে প্রাথমিক স্কুলের মতো ছয় সদস্য বিশিষ্ট ম্যানেজিং কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটির সভাপতি হবেন উপজেলা ইবতেদায়ী শিক্ষা কমিটি মনোনীত ব্যক্তি। সদস্য সচিব হবেন প্রধান শিক্ষক। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হতে হলে অন্তত এক লাখ টাকা এবং দাতা সদস্য হতে হলে এককালীন ৫০ হাজার টাকা মাদ্রাসার তহবিলে জমা দিতে হবে। কমিটি গঠনের ৩০ দিনের মধ্যে উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডকে জানাতে হবে। কমিটির মেয়াদ হবে তিন বছর। প্রতি পাঁচ বছর পর পর পাঠদানের স্বীকৃতি অনুমোদন করাতে হবে। এজন্য মাদ্রাসা বোর্ডে পাঁচ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। 

 

কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সূত্র জানায়, গত বছরের অক্টোবর মাসে মাদ্রাসা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রওনক মাহমুদকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন কর হয়। কমিটিকে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর আলোকে মাদ্রাসা স্থাপন, মঞ্জুরি, কমিটি গঠন, শিক্ষক নিয়োগ, পরিচালনা ও এমপিওভুক্তিকরণসহ জাতীয় মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী, আধুনিকায়ন ও কর্মমুখী করে গড়ে তুলতে একটি নীতিমালা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিটি কয়েক দফা বৈঠক করে নীতিমালা খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার আরেকটি বৈঠক করে চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। 

 

মাদ্রাসার শিক্ষকরা জানান, ১৯৮৪ সালে ৭৮ অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা নিবন্ধন দেওয়া হয়। তখন থেকে এসব মাদ্রাসার শিক্ষকরা বিনা বেতনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে আসছেন। ১৯৯৪ সালে একই পরিপত্রে সরকার রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতন ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে। পরবর্তিতে রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ধাপে ধাপে বেতন বাড়ানো হয়। ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি স্কুল সরকারি করা হয়। তবে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকরা মানবেতর জীবনযাপন করেন। শিক্ষকদের দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ২২ জানুয়ারি ১ হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ৫০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা করা হয়। পরে আরও এক দফা বাড়িয়ে প্রধান শিক্ষকদের বেতন ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং সহকারী শিক্ষকদের বেতন ২ হাজার ৩০০ টাকা করা হয়েছে। তবে বাকি মাদ্রাসার শিক্ষকরা ২৯ বছর ধরে বেতন ভাতা বঞ্চিত।

 

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক ঐক্য পরিষদের মহাসচিব ও নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্য মো. শামছুল আলম আজকালের খবরকে বলেন, ১৯৯৪ সালের পরিপত্রেই রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন-ভাতা সমান নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তিতে রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হলেও আমরা বঞ্চিত। নীতিমালায় সেই বৈষম্য থাকছে না।  

 

মাদ্রাসা বোর্ডের দেওয়া তথ্যানুযায়ী বর্তমানে ৬ হাজার ৯৯৮টি ইবতেদায়ী মাদ্রাসা আছে। তবে ২০১৬ সালের  ব্যানবেইসের হিসাবে এ সংখ্যা ৩ হাজার ৪৩৩টি, অনুদানপ্রাপ্ত মাদ্রাসার সংখ্যা ১ হাজার ৫১৯টি। এসব মাদ্রাসায় ১৫ হাজার ২৪৩ জন শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৫১ হাজার ৯৯৭ জন। তবে এর বাইরেও আরও অনেক মাদ্রাসা রয়েছে বলে শিক্ষক নেতারা দাবি করেছেন। প্রসঙ্গত জাতীয়করণের দাবিতে গত ১ জানুয়ারি থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনশনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা। পরে মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর সরকারের পক্ষ থেকে দাবি পূরণের আশ্বাস দিলে তারা আন্দোলন স্থগিত করেন।